যশোর অফিস : যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) উর্ধ্বতন হিসাব সহকারী মহাসিন আলী টানা ১৭ বছর ধরে একই স্থানে কর্মরত থাকার সুবাদে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আউটসোর্সিং জনবল নিয়োগে কোটি টাকার দুর্নীতি ও অনিয়মের সাথে জড়িত থাকার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগকারী চাকরিচ্যুত কর্মচারীবৃন্দ ও স্থানীয়রা অবিলম্বে তার প্রত্যাহার, শাস্তি এবং দুর্নীতির তদন্ত দাবি করে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। শুধু এই নয় দীর্ঘ বছর তিনি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের প্রভাব খাঁটিয়ে নিজ দপ্তরের উর্ধতন কর্মকর্তাসহ কর্মচারিদের হয়রানি ও সম্মানহানি করে যাচ্ছেন। তার ভয়ে অফিসের কেউ মুখ খুলতে পারেন না। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হলেও মহাসিন আলীর দাপটে তটস্থ পুরো অফিস।
অভিযোগ অনুযায়ী, মহাসিন আলী টানা ১৭ বছর ধরে যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডে কর্মরত। তিনি একাধারে জাতীয় শ্রমিক লীগ, যশোর জেলার শিক্ষা ও সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড শ্রমিক-কর্মচারী লীগ (সিবিএ) এর যশোর জেলা সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি। এই রাজনৈতিক পদাধিকার বলে তিনি এক স্থানে দীর্ঘকাল কর্মরত থেকে ঠিকাদারী ব্যবসাসহ বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন। স¤প্রতি, দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে স্থানীয় প্রভাবশালী এক নেতার সাথে সখ্যতার কারণে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
২০২৫-২৬ অর্থ বছরে যশোর পাউবোতে ৩১ জন জনবল আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় নিয়োগ প্রদান করা হয়। অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া। শুধু এই নয় তার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। বিগত ৩ বছর ধরে কাজ করে আসা ৭ জন কর্মচারীকে কোনো কারণ ছাড়াই বাদ দেয়া হয়। অভিযোগ, মহাসিন আলী তাদের কাছে ঘুষ বা নিয়োগ বাবদ মোটা অংকের টাকা চেয়ে না পেয়ে তাদের বাদ দেন। বাদ দেয়া ৭ জনের পরিবর্তে নতুন নিয়োগকৃত ৭ জনের প্রত্যেকের কাছ থেকে ৪ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই অর্থ লেনদেনে তার সহযোগী হিসেবে আবু সাইদ (ঝিনাইদহ) নামে এক ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে। মহাসিন আলী মেহেরপুরের হোটেল বাজার এলাকায় জোহা এন্টারপ্রাইজ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ভাড়া নিয়ে নিজে টেন্ডার দিয়েছেন এবং এই বাণিজ্যের মূলহোতা। নতুন ৭ জনের মধ্যে মো. হোজাইফা নামে একজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যার বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয়নি এবং জাতীয় পরিচয়পত্রও নেই। টাকার বিনিময়ে চাকরি দেয়ায় মহাসিন আলী একটি কম্পিউটার দোকান থেকে তার জন্য ভুয়া জন্মনিবন্ধন বানিয়েছেন বলেও দাবি করা হয়েছে। মুকুল হোসেন ও মাহফুজুর রহমানের কাছ থেকে টাকা নেয়া নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় তাদের পরিবর্তে কবির ও খালিদ নামে নতুন দু’জনকে টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দিয়েছেন এই মহাসিন। কিন্তু টেন্ডার ডকুমেন্টে তাদের সিভি বা বায়োডাটাই জমা দেয়া হয়নি।
[caption id="attachment_44757" align="alignnone" width="1726"]
যশোরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উর্ধ্বতন হিসাব সহকারী মহাসিন আলী একই কর্মস্থলে টানা ১৭ বছর।[/caption]
মহাসিন আলী নিজ ক্ষমতা বলে আবু অয়ন নামে এক কর্মচারীকে এক মাসের ছুটিও দিয়েছেন। যদিও নির্বাহী প্রকৌশলী বা উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলীই একমাত্র ছুটি দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। এছাড়াও, তিনি পোশাক দেয়ার নাম করে ঝিনাইদহ থেকে আবু সাইদের মাধ্যমে প্রত্যেক কর্মচারীর কাছে টাকা দাবি করেছেন বলেও জানা গেছে।এই দুর্নীতি ও চাকরিচ্যুতির প্রতিবাদে চাকরিচ্যুত কর্মচারীবৃন্দ ও তাদের পরিবারের সদস্যরা ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছেন। গত ২৮ সেপ্টেম্বর তারিখে তারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং যশোর প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন। মানববন্ধন শেষে তারা জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলামের কাছে অবিলম্বে মহাসিন আলীকে প্রত্যাহার ও শাস্তির দাবি এবং টেন্ডার বাতিল করে চাকরিচ্যুতদেরকে স্বপদে বহালের জন্য স্মারকলিপি পেশ করেন। জেলা প্রশাসক বিষয়টি গুরুত্বের সাথে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়কে অবহিতকরণের আশ্বাস দেন। তার দুর্নীতি ও অপকর্মের বিষয়ে গত ২৯ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সংবাদও প্রকাশিত হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর দৈনিক গ্রামের কাগজে একটি ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে আরও একটি দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশিত হয়।
মানববন্ধন ও সংবাদ প্রকাশের পর আন্দোলনকারীদের উপর দমন-নিপীড়নের এক নির্মম অধ্যায় নেমে এসেছে। আন্দোলনকারীরা একের পর এক হুমকি-ধামকিতে বিপর্যস্ত এবং মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীদের প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দেয়া হচ্ছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর আউটসোর্সিং কর্মচারী মাহমুদকে হুমকি-ধামকি ও মারধরের বিষয়ে যশোর কোতয়ালী মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। যার জিডি নং- ২৫৮৭।
মহাসিন আলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এটাই প্রথম নয়। ২০২১-২২ অর্থ বছরেও আউটসোর্সিং জনবল নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জেমসন ট্রেডিং স্ট্যাম্প ও সাক্ষর জালিয়াতির বিষয়টি লিখিতভাবে নির্বাহী প্রকৌশলীকে জানায়। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বোর্ড কর্তৃপক্ষ কমিটি পর্যন্ত গঠন করে। তবে সেবার তদন্ত কর্মকর্তারা বিষয়টি রফাদফা করে।
তার বিরুদ্ধে তদন্ত করতে আসা উপ-পরিচালক আব্দুর রাশিদের বিরুদ্ধে এই দুর্নীতিবাজ কর্মচারী মামলা পর্যন্ত করেছেন। এর প্রেক্ষিতে বোর্ডের শৃঙ্খলা পরিদপ্তর গত ২০২৩ সালের ২৯ আক্টোবর তদন্ত কর্মকর্তাকে নিজের পক্ষে প্রতিবেদন প্রদানের জন্য ঘুস বা উৎকোচ প্রদানের চেষ্টা করা, তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বোর্ডকে অবহিত না করে মামলা করার জন্য নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়। অভিযোগ, মহাসিন আলী এই দন্ড'র বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন এবং তার চাকরি বইতেও তা লিপিবদ্ধ করা হয়নি।
তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী হওয়া সত্তে¡ও মহাসিন আলী ঠিকাদারী ব্যবসা থেকে অর্জিত অবৈধ অর্থ দিয়ে যশোর জেলার সদর উপজেলার জামতলা মৌজাসহ আত্মীয় স্বজন ও পিতা-মাতার নামে নিজ গ্রামে অনেক জমাজমি ক্রয় করেছেন। তিনি দামি সুজুকি মোটরসাইকেল ও আইফোন ব্যবহার করেন। চিকিৎসার নামে ঘন ঘন ভারতে ভ্রমণ করেন এবং মোটা অংকের টাকা খরচ করেন। চাকরিচ্যুত কর্মচারীরা তার ও তার আত্মীয়-স্বজনদের সম্পত্তি ও ব্যাংক হিসাব তলব করার মাধ্যমে জ্ঞাত আয় বহির্ভুত সম্পদের বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দুদক যশোর অফিসেও স্মারকলিপি প্রদান করেছেন।
মহাসিনের খুঁটির জোর কোথায়?
এই মহাসিন বিগত আওয়ামী লীগ আমলে নিজেকে শ্রমিকলীগের নেতা পরিচয় দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করিয়েছে। সে সময় মামলার বাদী হিসেবে বেছে নিতেন নিম্ন আয়ের ছিন্নমূল মানুষদের। মামলার সকল ব্যয় তিনি বহন করতেন। বিগত দিনের পত্র পত্রিকা সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালে তিনি মানহানির অভিযোগ তুলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রশিক্ষণ পরিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুর রশিদের নামে যশোর আদালতে মামলা করেন। সংবাদটি ওই বছরের ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর স্পন্দন ও সমাজের কথা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। একই বছরের ৩১ ডিসেম্বর দৈনিক গ্রামের কাগজে ‘উর্ধ্বতন হিসাব সহকারী মহাসিন আলী কান্ড, ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে যশোর পাউবোর’ শিরোনামে ফলাও করে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেই সংবাদে বলা হয় মহাসিন যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে অতিষ্ঠ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মচারিরা। তার আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে লিখিত অভিযোগ করেন অফিস সহায়ক খবির হোসেন।
শুধু যশোর অফিস নয় তার অত্যাচারের কথা বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের শৃংখলা পরিদপ্তরও অবগত ছিলো। ২০২৩ সালে তাকে শাস্তি স্বরুপ তিরস্কার বা নিন্দা জানানো হয়। দপ্তরে দপ্তরে বেনামে মিথ্যা তথ্য সম্বলিত পত্র দেয়া মহাসিনের নেশা। তার এই নেশায় অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারি হয়রানি, সামাজিক সুনাম, চার্জভুক্ত ভ্রমণ ভাতা এমনকি মাসিক বেতন ভাতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অতীতের মত এখনও বেপরোয়া মহাসিন আলী। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ২০২১ সালে যশোর অফিসের সকল কর্মচারি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে লিখিত পত্রের মাধ্যমে অনাস্থা প্রকাশ করে।
তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাথে হাত মিলিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিকাংশ কাজ তিনি কূটকৌশলে পতিত ফ্যাসিস্টদের নামে বেনামে পাইয়ে দিতেন। কাজ দেয়ার সুবাদে নিজের ইচ্ছে খুশি মত অফিস করতেন। বর্তমান সময়ে তিনি ভোল পাল্টে একটি রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় এই সব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অফিসে লিখিত অভিযোগ জানানো হয়েছে। তারপরও তিনি শান্ত হচ্ছেন না। তার এই অনিয়ম অত্যাচারের শেষ কোথায়? আর কি বা তার ক্ষমতার উৎস এমন প্রশ্ন এখন জনমনে।
চাকুরিচ্যুত দীপংকর দাস বলেন, আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব। আমার চাকরিচ্যুত করার কোনো কারণ নেই। প্রয়োজনে বড় পরিসরে আন্দোলন গড়ে তুলবো। তার এই অন্যায় মেনে নেয়ার মত না। চাকরি হারিয়ে আমি অসহায় হয়ে পড়েছি। আমার উর্ধতন কর্মকর্তারা বলেছে আমার সাথে অন্যায় করা হয়েছে। দীর্ঘ ১৭ বছর এক জায়গায় থাকার কারণে মহাসিন অবৈধ অর্থের জোরে এসব কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। শ্রমিকলীগ করার কারণে বিগত দিনে সে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। এখন অপর একটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে সে অর্থের বিনিময়ে ভালো সম্পর্ক করেছে। সে সবার কাছ থেকে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা নিয়েছে চাকরি দেবে বলে। আমি গরিব মানুষ আগে থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডে কাজ করতাম সে কারণে সে আমাকে বলেছিলো। অল্প কিছু টাকা দিলে হবে। তার কথা শুনে মনে হয়েছিলো ২ থেকে ৩ লাখ টাকা দিলে আমার চাকরি হবে। পরবর্তীতে সে বলে অল্প টাকাতে হবে না।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের উর্ধ্বতন হিসাব সহকারী মহাসিন আলী বলেন, আগেও আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলো। অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। আমার কোনা রাজনৈতিক দলের পদ পদবি নাই। আমি ১৭ বছর একটানা যশোরে চাকুরি করছি না। আলাদাভাবে ৫ থেকে ৭ জায়গায় চাকরি করেছি। আমার বিরুদ্ধে যে জিডি করা হয়েছে সে বিষয়ে আমি অবগত না। যে দল ক্ষমতায় থাকে সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে সে দলের সাথে চলতে হয়।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।
ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী ,সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইমেইল: [email protected], web:www.etihad.news
এম এম রহমান, প্রধান সম্পাদক, ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত