নির্বাচিত সংবাদ

বরিশালের ‘ফুসফুস’ বিবির পুকুর ও বেলস পার্ক অবৈধ স্থাপনায় অবরুদ্ধ

বিবির পুকুর ও বেলস পার্ক
print news

মামুনুর রশীদ নোমানী,বরিশাল:  বরিশালের প্রানকেন্দ্র বিবির পুকুর ও বেলস পার্ক।নগরীর সাধারন মানুষদের নিঃশ্বাস নেয়ার অন্যতম স্থান।বিকেল গড়ানোর পরেই মানুষ একটু দম নেয়ার জন্য এখানে আসে।
সম্প্রতি দুটো স্থান থেকেই অবৈধ দখলদার ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বরিশাল সিটি করপোরেশন।উচ্ছেদের পরই নগরবাসী সন্তোষ প্রকাশ করে।সর্বমহলে প্রশংসিত হয় বিসিসির উচ্ছেদ কার্য্যক্রম উদ্যোগ।উচ্ছেদের সপ্তাহ না পেরোতেই নিরাশ হয় সাধারন মানুষ।বিবিরপুকুর পাড় ও বেলস পার্কে অবৈধ দোকানগুলো বিসিসির লোগো সম্বলিত স্টিকার দোকানে লাগিয়ে পেল বৈধতা।

পুর্বের অবৈধ স্থাপনাগুলো পেল বৈধতা।বেড়েছে অবৈধ দোকানের সংখ্যা।ফলে বরিশালের ফুসফুস হলো অবরুদ্ধ।দুটি স্থানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। বিবির পুকুর পাড়ে বিসিসি একধাপ এগিয়ে লোগার খাঁচা দিয়ে ঘিরে ফেলে। ফলে বিবির পুকুর হারিয়েছে তার নিজস্ব সৌন্দর্য। বিবির পুকুরের সাথে কীর্তনখোলার সাথে একটি ড্রেনের মাধ্যমে সরাসরি সংযোগে বাসাবাড়ি, দোকান- পাটের ড্রেনেজ লাইন যুক্ত থাকায় পুকুরের পানি ব্যবহারের অনুপযোগী।অথচ বিবির পুকুরের পানি ব্যবহারের উপযোগী করার জন্য নেয়া হয়নি কোন উদ্যোগ।

খাঁচার ভেতর হারিয়ে যাবে বিবির পুকুর!

বরিশালের প্রানকেন্দ্রের অন্যতম স্থান বিবিরপুকুর।রয়েছে ইতিহাস।এটি একটি পুকুরই নয়।এর পিছনে রয়েছে ঐতিহাসিক গুর্রত্ব।খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারক উইলিয়াম কেরি ১৮০০ সালের দিকে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ যা বর্তমানে বরিশালে এসে এক মুসলিম মেয়েকে পর্তুগিজ দস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার করেন। নাম রাখেন জিন্নাত বিবি। নিঃসন্তান এই নারী ১৯০৮ সালে নিজের জমিতে এই পুকুর খনন করেন মানুষের উপকারে। সেই থেকে জলাশয়টির নাম, বিবির পুকুর।

অবৈধ স্থাপনা ও  খাঁচার ভেতর হারিয়ে যাবে বিবির পুকুর
অবৈধ স্থাপনা ও খাঁচার ভেতর হারিয়ে যাবে বিবির পুকুর । অবৈধ দোকানগুলো বিসিসির লোগো সম্বলিত স্টিকার দোকানে লাগিয়ে পেল বৈধতা –

১৮৫০ ফুট দৈর্ঘ্য, ৪০০ ফুট প্রস্থের এই পুকুরটি বিসিসির। পুকুরটির উন্নয়নে প্রথমে কাজ শুরু করেন বিসিসির সাবেক মেয়র মজিবর রহমান সরোয়ার।পরে সাবেক মেয়র মরহুম শওকত হোমেন হিরন বিবিরপুকুরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিকরনে একটি প্রকল্প গ্রহন করেন।সেই প্রকল্পের অধীনে পুকুরটি রক্ষা ও সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দা মাহমুদ জানান,বিসিসি বিবির পুকুরের পানি ব্যবহার উপযোগী না করে পরিকল্পনা বিহীন সৌন্দর্যের নামে বিবির পুকুরকে এখন অবরুদ্ধ করেছে যা নিন্দনীয়।তিনি বলেন,একসময় এ পুকুরের সঙ্গে পার্শ্ববর্তি কীর্তনখোলা নদীর যোগাযোগ থাকায় নিয়মিত জোয়ার-ভাটায় এর পানি ভালো থাকত। এ ব্যবস্থাটি আবারও চালু করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।স্থানীয় বাসিন্দারা বিবিরপুকুরকে নিয়ে একটি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এর সৌন্দর্য বৃদ্ধিকরন ও পানি ব্যবহারের উপযোগী করার জন্য বরিশাল সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন।

বরিশাল সিটি করপোরেশনের বাজার কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, কিছু ব্যক্তি অবৈধভাবে দোকান বসিয়ে ভাড়া তুলছিলেন, তাই উচ্ছেদ করা হয়েছে। বৈধ ব্যবসায়ীদের জন্য স্টিকার দেওয়া হচ্ছে, প্রতিদিন ৫০ টাকা ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। ময়লা যাতে পুকুরে না পড়ে, সে জন্যই গ্রিল ও নেট বসানো হচ্ছে। তিনি আরো জানান, পুকুরটি এখন স্থানীয় ব্যবসায়ী কালু সিকদারের ইজারায় রয়েছে এবং সেখানে মাছ চাষ চলছে। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজাউল বারী সংবাদিকদের জানান, ফোয়ারার কাজ প্রায় শেষ। কাজ শেষ হলে বিবির পুকুর তার আগের রূপ ফিরে পাবে।

বেলস পার্ক অবরুদ্ধ অবৈধ স্থাপনায়:

বরিশালের আরেক ফুসফুস বেলস পার্ক।এটিরও রয়েছে এক অনণ্য ইতিহাস।তবে এই স্থানের সাথে যুক্ত হয়েছে রাজনীতিও।আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকলে এর নাম রাখা হয় বঙ্গবন্ধু উদ্যান। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় না থাকলে পুরনো নাম বেলস পার্ক নামে ফিরে আসে।প্রতিদিন বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নগরীর সাধারন মানুষ এখানে ভীড় করেন। বিশুদ্ধ অক্সিজেন নিতেই মানুষের কোলাহল।ধীরে ধীরে অবৈধ স্থাপনার ভিড়ে সাধারন মানুষের মাঝে বিরক্তি আসে।বেলস পার্ককে ঘিরে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ দোকানপাট বসে। এসব দোকান পাট সরকারি জায়গায় হলেও মাটি ভাড়ার নামে চাদাঁ দিতে হয় স্থানীয় একদল লোকদেরকে।

বেলস পার্কে অবৈধ দোকানগুলো বিসিসির লোগো সম্বলিত স্টিকার দোকানে লাগিয়ে পেল বৈধতা -

বেলস পার্কে অবৈধ দোকানগুলো বিসিসির লোগো সম্বলিত স্টিকার দোকানে লাগিয়ে পেল বৈধতা –

মানবিকতার দোহাই দিয়ে এভাবে দোকান বসিয়েছে প্রশাসন নিজেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ করেন বেলস পার্কে আসা শোয়াইব নামে এক শিক্ষার্থী।বেলস পার্কের ওয়াকওয়ে ও মডেল স্কুল এন্ড কলেজের দেয়াল ঘেঁষে দু’পাশেই থরে থরে বসানো হয়েছে দোকান। আবার উম্মুক্ত শিশুপার্কের প্রবেশপথে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে ১০ টাকা প্রবেশ মূল্যের নোটিশ।সাধারণ মানুষ ও দর্শনার্থীদের দাবী, শিশুপার্কের জন্য ১০ টাকা প্রবেশ মূল্য নেয়া অনৈতিক। বেলস পার্ক জুড়ে এতো দোকান হওয়া উচিত নয়।

এখানে সকাল-সন্ধ্যা ওয়াকওয়ে ব্যবহারকারী বরিশাল বিভাগীয় প্রাতঃভ্রমণ ও শরীরচর্চা পরিষদের কয়েকজন সিনিয়র সিটিজেনও বিরক্তি প্রকাশ করলেন। বেলস পার্কের মাঠ জেলা প্রশাসনের। আর পার্কের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বরিশাল সিটি করপোরেশনের।বরিশালের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী এবং সভা সমাবেশের অন্যতম স্থান হিসেবে পরিচিত বেলস পার্কে গজিয়ে ওঠা এসব দোকানপাটকে ঘিরে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বাড়ছে বলেও অভিযোগ করেন তারা।

সম্প্রতি বেলস পার্কে থাকা অবৈধ স্থাপনা ও দোকান-পাটগুলো উচ্ছেদ করে বরিশাল সিটি করপোরেশন।এ খবরে সাধারন মানুষ খুশি হয়।তবে সপ্তাহ না পেরোতেই দোকানে বিসিসির লোগো লাগিয়ে বৈধতা নিয়ে পুর্বের ন্যায় ফিরে আসে অবৈধ দোকানগুলো।স্টিকারে পেল স্থায়ী বৈধতা।আগের থেকেও এখন দোকান পাটের সংখ্যা দিগুন।ফলে সাধারন মানুষ ক্ষুব্ধ বিসিসির প্রশাসনের প্রতি।

বেলস পার্কে অবৈধ দোকান ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বরিশাল সিটি করপোরেশন। 
বেলস পার্কে অবৈধ দোকান ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বরিশাল সিটি করপোরেশন।

নাগরিকরা চাইছেন, বেলস পার্কে যেন সত্যিকারের উন্নয়ন হয়- যে উন্নয়নে ফিরবে গাছ, ফুল, সবুজ আর ইতিহাসের মর্যাদা। না হলে এই ‘বরিশালের ফুসফুস’ একদিন পুরোপুরি নিশ্বাস নিতে ভুলে যাবে।ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে বেলস পার্কের ভাগ্যও পরিবর্তিত হয়েছে। কোনো সময় তা সংরক্ষণের উদ্যোগ দেখা যায়নি। বরং অবহেলা ও ধ্বংসের শিকার হয়েছে বেলস পার্ক।
স্থানীয় নাগরিক হুমায়ুন কবির বলেন, এই বেলস পার্ক একসময় ছিল শান্তির জায়গা। এখন যেখানে গিয়েই দেখি ছোট বড় দোকান পাট। ইতিহাসের জায়গাটা হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের চোখের সামনেই।

বেলস পার্কের রয়েছে গর্বিত ইতিহাস:

বেলস পার্কের রয়েছে গর্বিত ইতিহাস। বৃটিশ শাসনামলের শেষ দিকে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার জেলা প্রশাসক মিঃ বেল প্রায় পৌনে ৯ একর সরকারী খাস জমির ওপর এই পার্ক বা উদ্যানটি গড়ে তুলেছিলেন। তখন তার নাম অনুসারেই উদ্যানটির নামকরণ হয়েছিল ‘বেলস পার্ক’। পাকিস্তান আমলে গণপূর্ত বিভাগ এ পার্কটির মালিকানা সহ তার তত্বাবধানের দায়িত্ব লাভ করে। বছর কয়েক আগে উদ্যানটির দুই দিকে জেলা প্রশাসন থেকে নকশা খচিত বিশাল প্রস্তর খন্ডে ভূমির মালিক ‘বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসক’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশাল এ ময়দানে ইতোপূর্বে দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধান মন্ত্রী সহ বিভিন্ন জাতীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রেখেছেন। ২০০৪ সালে তৎকালীন সিটি মেয়র মজিবর রহমান সারোয়ারের উদ্যোগে সরকারী প্রায় ৩ কোটি টাকা সংগ্রহ করে গণপূর্ত অধিধপ্তরের মাধ্যমে উদ্যানটির চারিধারে ওয়াকওয়ে, বসার জন্য বেঞ্চি, ছাতা সহ শৌচাগার ও বিশ্রামাগার নির্মাণ ছাড়াও পুরো উদ্যানটি জুড়ে দৃষ্টি নন্দন লাইটিং-এর ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি শোভা বর্ধনের জন্য পুরো মাঠের চারধারে বৃক্ষ রোপন করা হয়েছিল। সে থেকে উদ্যানটির পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ও রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব গ্রহন করে সিটি করপোরেশন। প্রতিদিনই এ উদ্যানে সকাল-বিকেল প্রচুর লোক হাঁটতে ও সান্ধ্যকালীন বিনোদনে আসেন।

বেলস পার্ককে ঘিরে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ দোকানপাট
বেলস পার্ককে ঘিরে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ দোকানপাট।

২০১১ সালে তৎকালীন সিটি মেয়র শওকত হোসেন হিরন গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে তহবিল সংগ্রহ করে উদ্যানটিতে দ্বিতীয় ওয়াকওয়ে এবং পূর্বপার্শ্বে প্রধান সড়ক ঘেঁষে মুড়াল স্থাপনের পাশাপাশি উদ্যানটির পূর্বপাশের নালাটি সংস্কার করে সেখানে শাপলার আবাদ করেন।

এছাড়াও সংলগ্ন বাঁধ রোডে পাকা ফুটপাথ নির্মান সহ সোনালি গাছ লাগান হয়। যা এখনো নগরবাসীর চোখ জুড়িয়ে দেয়। দ্বিতীয় দফায় সংস্কারের পরে উদ্যানে প্রাতঃ ও বৈকালিক ভ্রমনকারীর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেলেও গত কয়েক বছর ধরে ভ্রমনকারীর চেয়ে আড্ডাবাজদের ভীড় আশংকাজনক হারে বেড়ে গেছে। সাথে উদ্যানটির পুরো উত্তর পাশ জুড়ে নানা ধরনের পথ খাবারের দোকান আড্ডাবাজদের জন্য বাড়তি সুবিধা সৃষ্টি করছে।বেলস পার্কের আগের রুপ ফিরে আনতে না পারলেও এর সৌন্দর্যরূপ ফিরিয়ে আনার দাবী করেছেন এখানে আসা লোকজন।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.