ইত্তেহাদ নিউজ,অনলাইন : বদলি বাণিজ্য, ঘুষ সিন্ডিকেট ও প্রশাসনিক দুর্নীতির অভিযোগে জর্জরিত মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিচালক (মাধ্যমিক) খান মাইনুদ্দিন সোহেল আবারও আলোচনায়। এবার তিনি নিজেকে মাউশির মহাপরিচালক (ডিজি) পদে বসানোর লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় ও রাজনৈতিক উচ্চপর্যায় পর্যন্ত অনৈতিক তদবীর শুরু করেছেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। অভিযোগ উঠেছে, তিনি বিগত সময়ে শিক্ষা প্রশাসনে গড়ে তোলা আর্থিক নেটওয়ার্ক ও প্রভাব ব্যবহার করে ডিজি পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। ফলে প্রশাসনের অভ্যন্তরে তীব্র অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। মাত্র কয়েক মাস আগেই খান মাইনুদ্দিন সোহেলের বিরুদ্ধে ১,৭০০ বদলির মাধ্যমে প্রায় ৫১ কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইকবালের মাধ্যমে এসব লেনদেন পরিচালিত হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ ছিল। এমন বিতর্ক ও অভিযোগের পরও এবার সেই কর্মকর্তা মাউশির সর্বোচ্চ পদে বসার দৌড়ে নাম লিখিয়েছেন। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সোহেল ইতোমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা এবং ক্ষমতাসীন দলের কিছু সাবেক ছাত্রনেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে ‘সুপারিশ ও তদবীর চেইন’ গড়ে তুলেছেন।
মাউশির এক সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “খান মাইনুদ্দিন স্যার গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ডিজি হওয়ার লবিংয়ে ব্যস্ত। মন্ত্রণালয়ে প্রতিদিন দেখা যাচ্ছে তার ঘনিষ্ঠদের আনাগোনা। তার অতীত বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও প্রভাব খাটিয়ে পদটি নিতে চান।” অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখা ও মাধ্যমিক শাখায় দুইজন অতিরিক্ত সচিবের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, যাদের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে। একজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, “ডিজি পদে তিনজন প্রার্থী শর্টলিস্টেড আছেন। এর মধ্যে একজনের প্রশাসনিক দক্ষতা, আরেকজনের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা বেশি। কিন্তু খান মাইনুদ্দিন টাকার জোর ও সম্পর্ক ব্যবহার করে অন্য দুজনকে বাদ দিতে চাইছেন।” মন্ত্রণালয়ের ভেতরকার একটি সূত্র দাবি করেছে, তার তদবীর কার্যক্রমে কিছু প্রভাবশালী সাবেক ছাত্রনেতা ও এক সাবেক মন্ত্রীপুত্রও সম্পৃক্ত রয়েছেন। তারা মন্ত্রণালয় ও সচিবালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে ফোনকল ও সুপারিশ পাঠাচ্ছেন। খান মাইনুদ্দিন সোহেলের বিরুদ্ধে যে পরিমাণ অভিযোগ রয়েছে, তাতে সাধারণত প্রশাসনিক তদন্ত বা বদলি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তিনি এখন পর্যন্ত বহাল তবিয়তে থেকে নিজের অবস্থান শক্ত করছেন।
মাউশির একজন উপপরিচালক বলেন, “তিনি জানেন, যদি তদন্ত শুরু হয়, তাহলে বদলি বাণিজ্যের সব কাগজ বেরিয়ে আসবে। তাই এখনই ডিজি পদে বসে পুরো বিষয়টা ঢেকে রাখার চেষ্টা করছেন।” অভিযোগ রয়েছে, তিনি ডিজি পদে বসতে পারলে নিজের বিরুদ্ধে চলমান প্রাথমিক তদন্ত নথিগুলো গোপন বা নষ্ট করার সুযোগ পাবেন।খান মাইনুদ্দিন সোহেল দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষমতাসীন একটি বলয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। ফ্যাসিস্ট আমলের রাজনৈতিক সংযোগ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি অধ্যাপক এনায়েতুল করিমের সহায়তায় পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন তার প্রশাসনিক ক্যারিয়ারে নতুন দরজা খুলে দেয়।
মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, “তিনি রাজনৈতিকভাবে চতুর। সব সময় ক্ষমতার ঘনিষ্ঠদের পাশে থাকেন। কোনো সময়ই সরাসরি রাজনীতি করেননি, কিন্তু সব সরকারের সময় টিকে আছেন।” এই রাজনৈতিক আশ্রয়ই এখন তার সবচেয়ে বড় মূলধন, যা তিনি ব্যবহার করছেন ডিজি নিয়োগ প্রক্রিয়ায়। খান মাইনুদ্দিন সোহেলের তদবীর শুরু হওয়ার পর থেকেই মাউশির অভ্যন্তরে বিভক্তি তৈরি হয়েছে। একপক্ষ তার ঘনিষ্ঠ, যারা ভবিষ্যতে পদোন্নতির আশায় তদবীরে নীরব সমর্থন দিচ্ছেন। অন্যপক্ষ বলছেন, “এতে মাউশির মর্যাদা ধ্বংস হবে।” এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা ভাবছিলাম, বদলি বাণিজ্যের পর অন্তত তাকে সরানো হবে। উল্টো এখন তিনি ডিজি হবেন! এতে আমাদের মতো সৎ কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে যাচ্ছে।”এদিকে, কিছু কর্মকর্তার মধ্যে ভয় কাজ করছে—তারা আশঙ্কা করছেন, যদি সোহেল ডিজি পদে বসেন, তাহলে যারা অতীতে তার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তাদের বদলি বা শাস্তি দেওয়া হবে।
সূত্রে জানা গেছে, গত এক মাসে খান মাইনুদ্দিন সোহেল অন্তত চারবার মন্ত্রণালয়ে গোপনে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছেন। এসময় তিনি নিজের যোগ্যতা তুলে ধরে বলেন, “আমি মাঠপর্যায়ের প্রশাসন বুঝি, ডিজি হিসেবে দ্রুত কাজ করতে পারব।”
তবে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের একাংশ বলছে, এই বৈঠকগুলো কেবল “যোগ্যতা প্রদর্শন নয়, বরং প্রভাব খাটানোর সুযোগ তৈরি।”একজন উপসচিব জানান, “তিনি সরাসরি টাকা অফার করেন না, তবে প্রতিশ্রুতি দেন—ডিজি হলে ‘সবাইকে সহযোগিতা করবেন’। এটা তদবীরের ভদ্র সংস্করণ।”
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আমরা যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও সততার ভিত্তিতে ডিজি নিয়োগ দিতে চাই। যেকোনো তদবীর বা লবিং আমাদের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করবে না।”তবে প্রশাসনিক অভ্যন্তরে সবাই জানেন, বাস্তবে এই পদগুলোতে রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রভাবই মূল ভূমিকা রাখে। তাই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সতর্ক থাকলেও তদবীর পুরোপুরি ঠেকানো যাচ্ছে না।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যে খান মাইনুদ্দিন সোহেলের বিরুদ্ধে প্রাপ্ত অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করছে। যদি তিনি ডিজি পদে বসেন, তাহলে তদন্ত বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কমিশনের এক কর্মকর্তা।একজন সাবেক শিক্ষা সচিব মন্তব্য করেন, “যার বিরুদ্ধে কোটি টাকার বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ প্রমাণসাপেক্ষে মন্ত্রণালয়ে আছে, তাকে ডিজি বানানো মানে দুর্নীতিকে পুরস্কার দেওয়া।”
শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, যদি অভিযোগযুক্ত কোনো কর্মকর্তা ডিজি পদে বসেন, তাহলে মাউশির প্রশাসনিক কাঠামোতে নৈতিকতা পুরোপুরি ভেঙে পড়বে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক (অব.) আবদুল হামিদ বলেন, “এই পদটি নীতিনিষ্ঠ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও নিরপেক্ষ নেতৃত্বের দাবি রাখে। বদলি বাণিজ্যে জড়িত কেউ সেখানে বসলে শিক্ষাক্ষেত্রে সৎ কর্মকর্তা-শিক্ষকদের আর কোনো আশ্রয় থাকবে না।”
একদিকে মাউশির বদলি বাণিজ্যের ভয়াবহ অভিযোগ, অন্যদিকে সেই অভিযোগের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিই এখন সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে বসার প্রতিযোগিতায়। এ যেন দুর্নীতিকে পুরস্কৃত করার প্রতীকী প্রতিচ্ছবি।যদি এমন একজন কর্মকর্তা মাউশির মহাপরিচালক হন, তাহলে বদলি বাণিজ্য বা ঘুষ সংস্কৃতি চিরতরে বৈধতা পাবে—এমন আশঙ্কা করছেন শিক্ষাপ্রশাসনের সৎ কর্মকর্তারা।তারা বলছেন, “এই নিয়োগ যদি হয়, তাহলে মাউশির ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হবে।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।
ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী ,সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইমেইল: [email protected], web:www.etihad.news
এম এম রহমান, প্রধান সম্পাদক, ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত