অবরুদ্ধ গাজায় ইসরাইলের হামলা : ইসরাইলি কারাগারে নির্যাতনের শিকার ফিলিস্তিনি বন্দিরা


আলজাজিরা, এপি, বিবিসি : অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের রাতভর হামলা এখন অনেক রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোমবার রাতে বিমানবাহিনী গাজার খান ইউনিস, রাফাহ এবং দেইর আল বালাহে হামলা চালিয়ে ৩০৬ নিরীহ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে।দক্ষিণে অবস্থিত এসব শহরেই নিরাপদে ফিলিস্তিনিদের সরে যেতে বলা হয়েছিল। হামলা থেকে বাঁচতে সবাই দক্ষিণের পথে পা বাড়ালেও জাতিসংঘ বলছে গাজার কোনো জায়গায়ই এখন নিরাপদ নয়।বিমান হামলার কারণে নিরাপদ করিডরই এখন ফিলিস্তিনিদের জন্য পরিণত হয়েছে মৃত্যু ফাঁদে। এদিকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ত্রাণ প্রবেশ এবং গাজা উপত্যকা থেকে জিম্মিদের বের করে আনতে গাজায় ‘কৌশলগত সামান্য বিরতি’ দেওয়ার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে।কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকার পরেও যুদ্ধবিরতির আহ্বান তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। খবর আলজাজিরা, এপি, বিবিসির। গাজায় ইসরাইলি হামলার ৩২তম দিনেও ৩০৬ জন নিহত হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত পার হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ারও কোনো সুযোগ নেই লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের। মিসরের সীমান্ত ঘেঁষা রাফাহ ক্রসিংও খোলা হচ্ছে শর্ত সাপেক্ষে। এ পরিস্থিতিতে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটে অবরুদ্ধ গাজার লাখ লাখ মানুষ এক প্রকার মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।এ অবস্থায় নেতানিয়াহু বলেছেন, সাধারণ যুদ্ধবিরতি যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করবে। তবে মানবিক কারণে লড়াইয়ে বিরতি দেওয়া ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন রয়েছে। পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।সোমবার এবিসি নিউজকে এক সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু বলেন, এখানে ১ ঘণ্টা, সেখানে ১ ঘণ্টা এরকম কৌশলগত সামান্য বিরতি আমরা আগেও দিয়েছি। আমি মনে করি, বিভিন্ন ধরনের পণ্য, মানবিক পণ্য আসার জন্য বা জিম্মিদের বের করে আনার জন্য এটা হতে পারে। তবে আমি মনে করি না যে, সাধারণ যুদ্ধবিরতি হবে। তিনি বলেন, গাজায় যুদ্ধ শেষ হলে ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য গাজার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে ইসরাইল।’এদিকে হামাস এবং ইসরাইলের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘাত ৩২ দিনে পৌঁছেছে। ৭ অক্টোবর হামাস ইসরাইলে রকেটর নিক্ষেপের পর গাজায় ক্রমাগত পালটা হামলা করতে থাকে ইসরাইল। গাজায় ইসরাইলি হামলার ভয়াবহতা ইউক্রেন যুদ্ধকেও ছাড়িয়ে গেছে। গত এক মাসে সেখানে যত হতাহত হয়েছে তা ২১ মাসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের হতাহতের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।মঙ্গলবার গাজার হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, সোমবার রাতভর ইসরাইলি বিমান হামলায় ৩০৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর ফলে ইসরাইলি হামলায় গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১০ হাজার ৩২৮ জনে পৌঁছেছে। নিহতদের মধ্যে ৪ হাজার ২৩৭ জনই শিশু ও ২৭১৯ জন নারী। ইসরাইলের এ হামলায় ফিলিস্তিনে আহত হয়েছেন আরও অন্তত ২৫ হাজার ৯৬৫ জন।গাজায় হামলা শুরুর পর প্রতিদিন গড়ে ১৩৪টি শিশু মারা যাচ্ছে। এ পর্যন্ত ৪২৩৭টি শিশু সেখানে মারা গেছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। সোমবার জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসও গাজায় যুদ্ধ বিরতির আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, গাজা শিশুদের জন্য কবরস্থানে পরিণত হয়েছে।
যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ইসরাইলি কারাগারে অমানবীয় নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা। নিষ্ঠুর ও বর্বরতা পূর্বের চেয়ে বহুগুণে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের গ্রেফতারও বেড়েছে।৭ অক্টোবরের আগে ইসরাইলি কারাগারে প্রায় ৫,২০০ ফিলিস্তিনি বন্দি ছিল যা যুদ্ধের পর দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্মকর্তা ও অধিকার গোষ্ঠীর মতে, যুদ্ধের পর থেকে ইসরাইল গাজা থেকে প্রায় ৪,০০০ শ্রমিককে গ্রেফতার করেছে। পৃথকভাবে পশ্চিম তীরের পাশাপাশি পূর্ব জেরুজালেমে রাতারাতি সেনা অভিযানে আরও ১,০৭০ ফিলিস্তিনিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।এদিকে বন্দিদের ওপর করা হচ্ছে অত্যাচার, মারধর এবং অমানবীয় আচরণ। বন্দি আইনজীবী সংগঠনগুলোর যৌথ বিবৃতি অনুসারে, ইসরাইলিদের দ্বারা নিয়মতান্ত্রিক বন্দিদের অপরাধের ভয়ংকর তথ্য উঠে এসেছে।ফিলিস্তিনি আটকদের ওপর সহিংসতা জোরদার করেছে ইসরাইলি বাহিনী। নারীদের ওপর চালানো সহিংসতা তুলনামূলক আরও বেশি। অধিকাংশ সময়ই বন্দিদের কক্ষে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রাখা হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে পানি ও খাবার থেকে বঞ্চিত করা হয়। মাঝে মাঝে ইসরাইলি পুলিশ বন্দিদের নির্যাতন করতে কুকুর, স্টান গ্রেনেড, টিয়ারগ্যাস এবং লাঠিসোঁটা ব্যবহার করে।টেনে হিঁচড়ে মাটিতে ফেলে একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। কেউ গুরুতর আহত হলে কারাগার কর্তৃপক্ষ চিকিৎসা থেকেও বিরত রাখে বন্দিদের। বন্দিদের স্বাস্থ্যের প্রতিও ইচ্ছাকৃত অবহেলা করা হয়। মানসিকভাবেও তাদের প্রতিনিয়ত হেনস্তা করা হয়। এমনকি কারাগারে নির্দিষ্ট গণ্ডির ভেতর অসংখ্য বন্দিকে একসঙ্গে রাখা হয়।একসঙ্গে ১০ জনেরও বেশি বন্দিকে ঘরে রাখা হয়। এমন অসংখ্য ফিলিস্তিনি বন্দি রয়েছেন যাদের নির্জন কারাগারে এককভাবে রাখা হয়। তদুপরি, যুদ্ধের প্রথম দিকে, ইসরাইল বন্দিশালায় টেলিভিশন, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বাজেয়াপ্ত করে, বন্দিদের জিনিসপত্র ধ্বংস করে, তাদের পোশাক বাজেয়াপ্ত করে। পাশাপাশি শারীরিক সহিংসতা, পারিবারিক পরিদর্শন স্থগিত করা, আইনজীবীদের সাথে দেখা করতে অস্বীকার করা এবং বান্দদের লন্ড্রি সুবিধাসহ নানা সুযোগ সুবিধা স্থগিত করা হয়েছে। আরব অর্গানাইজেশন ফর হিউম্যান রাইটস ইন ইউকে (এওএইচআর ইউকে) মতে, এই গ্রেফতার এবং আচরণগুলো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।রামাল্লাহর অধিকার গোষ্ঠীর প্রধান সাহার ফ্রান্সিস বলেছেন, ‘গ্রেফতারগুলো এখন ২৪ ঘণ্টা চলছে। গাজার বেশির ভাগ লোককে দক্ষিণ নাকাব মরুভ‚মির কাছে শেডে টাইম্যান নামক একটি সামরিক ঘাঁটিতে আটকে রাখা হয়েছে। রামাল্লার কাছে ওফার কারাগারে এবং অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমের আনাতা গ্রামের কাছে আনাতোট সামরিক ক্যাম্পে আরও কয়েকশ বন্দি রয়েছেন।রামাল্লায় এক সংবাদ সম্মেলনে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের বন্দিবিষয়ক কমিশনের প্রধান কাদুরা ফারেস বলেছেন, বন্দিদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো ‘অভূতপূর্ব’ এবং ‘বিপজ্জনক’। গত কয়েক দিন ধরে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের প্রত্যেককে ভীষণভাবে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। অনেক বন্দির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তাদের সঙ্গে অবমাননাকর ও অপমানজনক অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হচ্ছে।বন্দিরা অনাহার ও তৃষ্ণার শিকার হয়। তাদের ওষুধ সরবরাহে বাধা দেওয়া হয়। যখন তারা প্রশাসন পানি ও বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয় তখন বিষয়টি আরও খারাপ হয়ে যায়।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news