সাদিক আবদুল্লাহর ‘রাজ্যে’ ভয়ের সংস্কৃতি থেকে মুক্ত বরিশাল


বরিশাল অফিস : বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর ‘রাজ্যে’ সবাই ছিলেন বোবা। প্রতিকারের চেষ্টা দূরে থাক, ভয়ে কেউ তাঁর ‘শাসনের’ বিরুদ্ধে মুখ পর্যন্ত খোলেননি। মেয়র পদে সাদিক আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পাওয়ায় বোবা হয়ে থাকা মানুষ কথা বলতে শুরু করে। জানান নিজেদের ক্ষোভ ও গুরুতর সব অভিযোগের কথা। নকশাবহির্ভূত নির্মাণের কারণ দেখিয়ে বাড়ি ভেঙে দেওয়া, জরিমানার নামে টাকা আদায়, ব্যবসায়ীদের কাছে কমিশন দাবি, ভবন নির্মাতাদের কাছে ফ্ল্যাট দাবি, রাজনৈতিক বিরোধীদের মারধর, কথায় কথায় সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করাসহ বহু অভিযোগ রয়েছে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে। মেয়রের নির্দেশে না চললে হয়রানি ও মিথ্যা মামলায় জেল খাটানো হয়েছে। পূজা উদযাপন পরিষদের কমিটি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি, বরিশাল ক্লাবও দখল করেছেন সাদিক আবদুল্লাহ কিন্তু কেউ টুঁ শব্দ করতে পারেননি।
আরও পড়ুন :
অব্যাহতি নিচ্ছেন মেয়র সাদিক, দেখা হবে না চাচা-ভাতিজার
২০১৮ সালের নির্বাচনে একতরফা জয় পান আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী সাদিক আবদুল্লাহ। পরের বছর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদও বাগিয়ে নেন। তাঁর বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগনে এবং পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ছেলে। আবুল হাসানাত বরিশাল-১ আসনের এমপি এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। পূর্ণ মন্ত্রীর পদমর্যাদায় তিনি পার্বত্য শান্তি চুক্তি নিরীক্ষা কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্বে রয়েছেন। বরিশাল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং স্থানীয়দের ভাষ্য, মেয়র এবং সাধারণ সম্পাদকের পদ পেয়ে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন সাদিক আবদুল্লাহ। তাঁর অনুগতরা পান আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের পদপদবি। তাঁর বিরোধিতা করলে শুধু অপমান, হয়রানি, মামলা নয়– নকশাবহির্ভূত নির্মাণের অভিযোগ তুলে বাড়িতে সিটি করপোরেশনের বুলডোজার চালানোর ভয়ে সবাই চুপ থাকতেন।
সাদিকবিরোধী হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ নেতারা এলাকায় রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারেননি। অনেকে ছিলেন এলাকাছাড়া। সিটি করপোরেশনের মেয়ররা নিজ এলাকায় সচিব পদমর্যাদা পান। তবে সাদিক আবদুল্লাহ মন্ত্রীদের মতো গাড়িবহরে পুলিশের জিপ নিয়ে চলতেন। তাতে জনমানুষের মাঝে ভয় আরও বাড়ে। এবারের নির্বাচনে তাঁকে বাদ দিয়ে তাঁর আপন চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহকে প্রার্থী করে আওয়ামী লীগ। যিনি খোকন সেরনিয়াবাত নামেই বেশি পরিচিত। তিনিও সাদিক আবদুল্লাহর বিরোধী।
খোকন সেরনিয়াবাতের মেয়র অনেকে পটপরিবর্তন হিসেবে দেখছেন। এখন অনেকেই মুখ খুলতে শুরু করেছেন। বরিশাল-৫ (সিটি করপোরেশন এবং সদর উপজেলা) আসনের এমপি এবং পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম গত ৩০ এপ্রিল খোকন সেরনিয়াবাতকে নিয়ে নেতাকর্মীর মতবিনিময় সভায় বলেছেন, বরিশাল মুক্ত হয়েছে। বরিশালে অনেক অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও সন্ত্রাস হয়েছিল। গত চার বছর আমরা কত কষ্টে অতিবাহিত করেছি। আমরা ভয় পেতাম। কত লোককে তারা আহত করেছে। কত লোককে তারা বেইজ্জতি করেছে।
একই কথা বলছেন সাদিকের আপন মামা কাজী মফিদুল ইসলাম কামাল। কাজী কামাল নামে পরিচিত এই ব্যবসাসী বরিশাল ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। তিনি বলেন, ২০১৯ সালের মার্চে নির্বাচন ছাড়াই ক্লাবের সভাপতির পদ দখল করেন মেয়র। সভাপতি হতে সদস্য হিসেবে অন্তত ১০ বছর থাকতে হয়। কিন্তু ২০১৬ সালে সদস্য হওয়া সাদিক ভোট ছাড়াই সভাপতি বনে যান।
আরও পড়ুন :
সরে দাঁড়ালেন মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ
এতদিন কেন আইনি ব্যবস্থা নেননি– প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘মানসম্মানের ভয়ে মামলা করতে পারিনি। কেউ মুখ খুললে, বাড়িতে হামলা করত সাদিক আবদুল্লাহর অনুগত ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ নামধারীরা। মারধর ও গালিগালাজের ভয়ে কোনো ভদ্রলোক কথা বলতে পারেননি। এখন মামলা করব।’ কাজী কামালের ভবন নির্মাণের ব্যবসা রয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠান বরিশালের দক্ষিণ চকবাজারের বিউটি রোডে পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করছে। তিনি জানান, বরিশালে যারাই ভবন নির্মাণ করেছে, তাদের কাছে কমিশন হিসেবে ফ্ল্যাট অথবা ফ্লোর চাইতেন সাদিক আবদুল্লাহ। না দিলে কাজ বন্ধ করে দিতেন। পাঁচতলা পর্যন্ত ভবন তোলার পর তাঁর কাছেও অংশীদারিত্ব চেয়েছিলেন তাঁর ভাগনে। রাজি না হওয়ায় ভবনটি নকশা মেনে হচ্ছে না অভিযোগ, চার দিকে ১০ ফুট করে ভেঙে দেয় সিটি করপোরেশন।
বরিশাল বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি এবং ফরচুন গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের অভিযোগ, সাদিক আবদুল্লাহ ব্যবসায়ীদের হয়রানি এবং ব্যবসায়িক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন। তিনি জানান, বিসিকের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে কর দাবি করেন মেয়র। যে ব্যবসায়ীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো তাঁর জন্য কর নির্ধারণ করেন ৫ হাজার টাকা। যে ব্যবসায়ী অনুগত নন, তাঁকে ৫ লাখ টাকা কর ধার্য করেন। বিসিকের কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠাকে ট্রেড লাইসেন্স দিচ্ছে না করপোরেশন। ফরচুন গ্রুপের সব শিল্পপ্রতিষ্ঠান ট্রেড লাইসেন্স ছাড়াই চলছে।
মিজানুর রহমান জানান, আমির হোসেন আমু শিল্পমন্ত্রী থাকাকালে বরিশাল বিসিকের অভ্যন্তরে ভূমি উন্নয়ন এবং সড়ক নির্মাণে ৭৪ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদিত হয়। শিল্প মন্ত্রণালয়ের এই প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজ পেয়েছিল এম এম বিল্ডার্সসহ বরিশালের বাইরের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। ২০১৮ সালে সাদিক মেয়র হওয়ার পর ৩ বছর ঠিকাদারদের কাজ করতে দেননি। কেন কাজ করতে দেননি– প্রশ্নে ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘সাদিক আবদুল্লাহর লোকেরা কাজ না পাওয়ায় বাধা তৈরি করেন। ঠিকাদাররা কাজ করতে না পারায় ফরচুন তাদের হয়ে ভূমি উন্নয়ন এবং সড়ক নির্মাণকাজ করলে তাঁর অনুসারীরা হামলা করে। আমার ভাইয়ের হাত ভেঙে দেয়।’ মিজানুর রহমানের দাবি, তাঁর বিরুদ্ধে অপহরণসহ আরও কয়েকটি মামলা করিয়েছেন মেয়র। বরিশালের বড় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একটি পলি ইঞ্জিনিয়ারিং। সাদিক আবদুল্লাহর মানহানির মামলায় প্রতিষ্ঠানটির মালিক আকবর হোসেন ৩৫ দিন জেলে ছিলেন। তাঁকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। আকবর হোসেন বর্তমানে ঢাকায় থাকছেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বলেন, ‘আমার সঙ্গে কী হয়েছিল, তা বলতে কষ্ট হচ্ছে। প্রতিবাদ করার বয়স, শারীরিক শক্তি বা টাকা কোনোটাই আমার আর নেই। সব খুইয়েছি।’ তিনি জানান, সাদিক আবদুল্লাহর করা মামলায় বরিশালের আদালতে একজন উকিলও তাঁর ভয়ে আমার পক্ষে দাঁড়ায়নি।
আরও পড়ুন :
মেয়র সাদিকের বিদায়ের পরপরই প্রকল্পের অনুমোদন পেল বিসিসি
বরিশালের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ওবায়দুল্লাহ সাজু আরও কয়েকজন অংশীদারের সঙ্গে নগরীর ফকিরবাড়ী সড়কে ৯ তলা ভবন নির্মাণ করছেন। এই ভবনটি নকশাবহির্ভূত অভিযোগে সিটি করপোরেশন ৪৫ লাখ টাকা জরিমানা করে। আরও অনেক ভবন নির্মাণকারীকে জরিমানা করেন মেয়র। সাজু জেলার সরকারি আইনজীবী হলেও আইনি প্রতিকার চাননি। তিনি বলেছেন, ‘একটি পিলার নকশার বাইরে ছিল। ভবনের ফ্ল্যাট বিক্রি করা হয়ে গেছে। ভবন ভাঙলে তাদের ক্ষতি হতো। জরিমানার টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়েছে।’
সাদিকের ঘোর বিরোধী পরিচিত কয়েকজন নেতার অভিযোগ, করপোরেশনে নয়, মেয়রের অ্যাকাউন্টে গেছে জরিমানার টাকা। বরিশালের আসমত আলী খান ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষক এম জসীম উদ্দিন বিদ্যালয়ের জমিতে মার্কেট নির্মাণে দুর্নীতির মামলায় ২২ দিন জেল খেটেছেন। তবে তাঁর অভিযোগ, এ নিয়ে মেয়র সাদিকের লোকজনের সঙ্গে বিরোধ এবং তাঁর পোশাক নিয়ে মেয়রের কটূক্তির জবাব দিয়ে রোষানলে পড়েন। মেয়রের অনুগত মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহমুদ বাবু বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার কমিটির আহ্বায়ক হয়ে জসীম উদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। প্রধান শিক্ষকের কোয়ার্টারের বিদ্যুৎ এবং পানির সংযোগও বিচ্ছিন্ন করা হয়।
বরিশালের সামাজিক সংগঠনগুলোতেও মেয়রের একচ্ছত্র প্রভাব ছিল। মহানগর পূজা উদযাপন এবং হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতৃত্বে অনুগতদের বসান সাদিক আবদুল্লাহ। এতদিন কেউ কথা না বললেও, তিনি বরিশাল ছাড়ার পর হিন্দু সমাজের নেতারাও মুখ খুলেছেন। হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সুরঞ্জিত দত্ত লিটু জানান, ২০২১ সালে পূজা উদযাপন পরিষদের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি মানু লাল দেকে সভাপতি এবং বিশ্বজিৎ ঘোষ বিশুকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করেছিল। কিন্তু সাদিক কেন্দ্রীয় নেতাদের ডেকে নিয়ে নিজের অনুগতদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করেন; যারা বিতর্কিত হিসেবে পরিচিত। বরিশালের ১০৯টি মন্দিরের প্রতিনিধিরা মেয়রের দেওয়া কমিটি মেনে নেননি। এখন আইনি প্রতিকার চাওয়া হবে।
সাদিক আবদুল্লাহ জমানায় বিনা নোটিশে চাকরি হারানো বরিশাল সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও মুখ খুলেছেন। প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, তিনজন নির্বাহী প্রকৌশলী, প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাসহ ৩৫ জন চাকরি হারিয়েছেন। দায়িত্ব থেকে সরানো হয় ২৮ জনকে। তাঁরা অফিসে হাজিরা দিলেও বেতন পাচ্ছেন না। আরও ১২ জন কর্মচারীকে করপোরেশনে আসতে মানা করেছেন মেয়র। তাঁরা কাজ না করেও বেতন পাচ্ছেন।
চাকরিচ্যুত কর্মচারী জাহাঙ্গীর বলেন, বরিশাল সিটি করপোরেশনের আইন অনুযায়ী চাকরিচ্যুত করতে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে হয়, বিভাগীয় মামলা করতে হয়। কিন্তু কাজে অমনোযোগিতা, অফিসে নিয়মিত না আসার অভিযোগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আইনের নজির দিয়ে তাঁকে সরাসরি চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। চাকরিহারারা রিট করেছেন। কিন্তু মেয়র হাইকোর্টের রুলের জবাবও দেননি।
গরিবের প্লট সচ্ছলদের দিলেন সাদিক আব্দুল্লাহ:
বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের আরজুমনি স্কুল সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা মুদি দোকানি খলিলুর রহমান আবেদন করেছিলেন সিটি কর্পোরেশনের স্বল্প আয়ের আবাসন প্রকল্পের প্লট বরাদ্দ চেয়ে। কিন্তু তিনি প্লট পাননি। স্ত্রী ও সন্তানের নামে দুটি প্লট পেয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ।খলিলুর রহমান বলেন, প্লটের আবেদনের ক্ষেত্রে প্রথম শর্তই ছিল- যিনি সিটি এলাকায় কোনো বাড়ি, ঘর, ফ্ল্যাট বা আবাসিক জমির মালিক তিনি আবেদনের অযোগ্য। অথচ সাদিক আব্দুল্লাহ যে ২৪০ জনকে প্লট বরাদ্দ দিয়েছেন তাদের সবার এই নগরীতে বাড়ি, গাড়ি, সম্পত্তি রয়েছে।শুধু খলিলুর রহমান নয়, এমন হাজারো স্বল্প আয়ের বাসিন্দাদের অভিযোগ আবাসন প্রকল্পের অনিয়ম নিয়ে। মূলত নামে স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য আবাসন প্রকল্প হলেও স্বল্প আয়ের মানুষদের প্লট না দিয়ে ধনাঢ্য-কোটিপতিদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর সবগুলো প্লট পেয়েছেন বিদায়ী মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারী রাজনৈতিক কর্মী, নগর ভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ছাত্রলীগ নেতা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-সাংবাদিক সংগঠনের লোকেরা। তাদের নিজস্ব জমি, বাড়ি ও সম্পত্তি রয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, খয়ের খাঁদের পুরস্কৃত করতে বিদায়বেলায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন মেয়র সাদিক।জানা গেছে, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ময়লাখোলা এলাকার ১১ একর জমি ২০১৩ সালে অধিগ্রহণ করেন সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামালের পরিষদ। তিনি আবাসন প্রকল্পের উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। ২০১৮ সালে মেয়র নির্বাচিত হয়ে আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নে হাত দেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদিক আব্দুল্লাহ।নগর ভবন থেকে জানা গেছে, নিম্নআয়ের মানুষের জন্য উদ্যোগ নেওয়া এই আবাসন প্রকল্পে মোট ২৪০টি প্লট নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে ২ দশমিক ৮৭ শতাংশের ১৩০টি, ২ দশমিক ৪৮ শতাংশের ৪৮টি, ২ দশমিক ৯৮ শতাংশের ৪০টি এবং ৩ শতাংশের ১২টি প্লট। প্রতি শতাংশের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৬ হাজার ৪৩১ টাকা। প্লট বরাদ্দের বিজ্ঞপ্তি ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। এতে স্বল্প আয়ের মানুষের বসবাসের সুবিধার জন্য ১০ বছরে কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য সুবিধায় প্লট বরাদ্দের বিষয়ে বলা হয়। প্লট বরাদ্দের আবেদন চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিলেও ২০২৩ সালের শুরুতে প্লট বরাদ্দের লটারি প্রক্রিয়া শেষ করা হয় অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে। তবে মেয়রের দায়িত্ব হস্তান্তরের আগে প্লট বুঝে নিতে প্লটপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা প্লটের মোট মূল্যের ২৫ শতাংশ হারে প্রথম কিস্তি পরিশোধ করে বালু ফেলে স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেন। আর তখনই বেড়িয়ে আসে থলের বিড়াল।এদিকে নগর ভবন থেকে প্লটপ্রাপ্তদের তালিকার জন্য সম্পত্তি শাখায় যোগাযোগের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাস। তিনি নিজেও প্লট পেয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক মো. আনজুমের বাবা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক ধর্মবিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম প্লট পেয়েছেন। অথচ শহীদ আরজু মনি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাশে পাওয়া প্লটের সামনেই তাদের নিজেদের বাড়ি রয়েছে। শুধু তাই নয়, প্যানেল মেয়র গাজী নাঈমুল হোসেন লিটু, মহানগর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক জিয়াউর রহমান, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সুমন সেরনিয়াবাত, মেয়রের ব্যক্তিগত সহকারী ও তার শ্যালক মোস্তফা জামান মিলন, মেয়রের ব্যক্তিগত সহকারী-২ শাহরিয়ার রিজন, ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জিয়াউদ্দিন, চিফ অ্যাসোসর মোয়াজ্জেম হোসেন, প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সানজিদ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা রফিক সেরনিয়াবাত এই প্লট পেয়েছেন।
এছাড়া মেয়র অনুসারী ১১ জন সাংবাদিক পেয়েছেন প্লট। যাদের সকলেরই নিজস্ব সম্পত্তি রয়েছে নগরীতে। ঝুমুর বেগম নামে এক বাসিন্দা বলেন, আমার শ্বশুরের ২৬ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আবাসনের প্লট পাওয়ার সুযোগ পেলে আমরা ছিলাম সবার আগে। কিন্তু আমরা আবেদনই করতে পারিনি। সাদিক আব্দুল্লাহ তার নিজের লোকদের নামে প্লট বরাদ্দ দিয়েছেন। সম্পূর্ণরূপে অবৈধভাবে তার লোকদের, যাদের দ্বারা নগরী শাসন করেছেন এই পাঁচ বছর তাদের প্লট দিয়েছে। রাবেয়া বেগম নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, ড্রেন-রাস্তা করবে এমন আশ্বাস দিয়ে আমাদের জমি অধিগ্রহণ করে নেওয়া হয়। এখন দেখছি কোটিপতিদের প্লট দিচ্ছেন সাদিক আব্দুল্লাহ। অথচ আবাসনের প্লট পাওয়ার কথা গরিব-অসহায়দের। তা না করে ছাত্রলীগ নেতা, সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাদিকের লোকদের প্লট উপহার দিয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্লট বরাদ্দে ২০ শতাংশের বেশি মেয়র নিজের হস্তক্ষেপে দিয়েছেন। এছাড়া বাকি ৭৯ শতাংশ প্লট রাজনৈতিক বিবেচনায় দিয়েছেন।প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ তুলে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করলে চলতি বছরের ২৯ আগস্ট আদালত তিন মাসের জন্য স্থিতাবস্থা জারি করেন বলে জানিয়েছেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। তিনি জানান, ৮ মার্চ মেয়রসহ চারজনের বিরুদ্ধে রুল জারি করেন আদালত। কিন্তু রুলের কোনো জবাব দেননি বিবাদীরা। ফলে ২৯ আগস্ট আবাসন প্রকল্পের সব কার্যক্রমের ওপর তিন মাসের স্থিতাবস্থা জারি করেন। স্থিতাবস্থা জারির পরও কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন বরাদ্দ প্রাপ্তরা। তবে স্থানীয়দের বাধার মুখে পুলিশ গিয়ে তা বন্ধ করে দেন ।
বরিশাল ক্লাব দখল :
বরিশাল ক্লাবের সভাপতির পদে থাকা সিটি করপোরেশন মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহকে নোটিশ দিয়েছেন আদালত। সোমবার (১৭ জুলাই) বরিশাল সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের বিচারক হাসিবুল হাসান নোটিশ জারি করে ১০ দিনের মধ্যে জবাব দেওয়ার নির্দেশ দেন। একই আদেশ দেন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বরিশাল আমিনুল ইসলাম পরাণের বিরুদ্ধেও। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আদালতের সেরেস্তাদার আব্দুল কাদের খান।মামলার বাদী মফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, সাদিক আব্দুল্লাহ বরিশাল ক্লাবের গঠনতন্ত্র ভেঙে পদ দখল করে রেখেছেন, তার প্রমাণ দেখে ১০ দিনের মধ্যে তাকে ব্যাখ্যা দিতে বলেছেন বিচারক। মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আজ মামলা গ্রহণ করে বরিশাল ক্লাবের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে কেন নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেওয়া হবে না জানতে চেয়েছেন বিচারক। বাদী অভিযোগ করেন, সাদিক আবদুল্লাহ ক্লাবের স্বার্থ পরিপন্থি বিভিন্ন কর্মকাণ্ড করেন। বিভিন্ন সময় তাকে পদ ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়। কিন্তু বিবাদী গত ৭ জুলাই পদ ছাড়বেন না বলে জানালে বাধ্য হয়ে মামলা দায়ের করেন।তিনি বলেন, ক্লাবের সভাপতি পদে নির্বাচন করতে হলে সদস্য পদের মেয়াদ ১০ বছর হতে হবে। বর্তমান সভাপতি সাদিক আবদুল্লাহ ২০১৬ সালের ২০ আগস্ট সদস্য হন। ২০১৯ সালের ৮ মার্চ সভাপতির পদ দখল করেন। ক্লাবের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ২০২৬ সালে সভাপতি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন তিনি।তার অভিযোগ, সাদিক আব্দুল্লাহ ক্লাবের সভাপতি থাকাকালে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে ক্লাবে থাকার জন্য দুটি রুমের ব্যবস্থা করে দেন। এ ছাড়াও ক্যাফেটেরিয়ায় বিল ও মেয়রের কাছে লোকের অনুষ্ঠানের-সহ কোটি কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। কোনও টাকাই পরিশোধ করেননি তিনি।গঠনতন্ত্র ভঙ্গ করে বরিশাল ক্লাবের সভাপতির পদ দখল ও পদ না ছাড়ার ঘোষণায় বিদায়ী সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই) দুপুরে বরিশাল সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে মামলাটি করেন ক্লাবের সদস্য মফিজুর রহমান চৌধুরী। তিনি বরিশাল ক্লাবের ৪৬২ নম্বর সদস্য এবং নগরীর দক্ষিণ আলেকান্দা আমতলা এলাকার মৃত মনু চৌধুরীর ছেলে।
ভোগান্তি নগরবাসীর :
মেয়র কামালের সময় একবার সড়কে খোয়া ফেলা হয়েছিল। কিন্তু কার্পেটিং হয়নি। মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ এসেও খোয়া ফেলেছেন। কিন্তু কার্পেটিং হওয়ার আগেই কাজ বন্ধ হয়ে গেছে।বৈদ্যপাড়া এলাকার বাসিন্দা কামাল বলেন, সিটি নির্বাচনের আগে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়। কিন্তু ভোটের পর থেকে কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। খোঁড়াখুঁড়ির আগে রাস্তা দিয়ে রিকশা চলাচল করতো। এখন হাঁটাচলাই দায় হয়ে পড়েছে। আবার সিঅ্যান্ডবি রোডের অগ্রভাগের রাস্তায় ড্রেনের কাজ চলছিল, সেটিও মুখ থুবড়ে পড়েছে। স্ল্যাব ছাড়া ড্রেন নিয়ে এলাকার সবাই আতঙ্কে আছে।একই অবস্থা তালভিটা রোডেরও। বিদায়ী মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারীরা রাস্তার কাজ শুরু করেছিল, এখন বন্ধ করে রেখেছে। রাস্তা কেটে কোনোরকম একটি ড্রেন তৈরি করা হয়েছে। অনেক জায়গায় নালা কেটে রড দিয়ে রাখলেও ঢালাই করা হয়নি। ড্রেনগুলোও খোলা অবস্থায় থাকে। এতে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।বিষয়গুলো নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি তথা কাউন্সিলরদের সঙ্গে স্থানীয়রা খোলামেলা কথাও বলেছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি বলে দাবি করছেন তারা। এ ব্যাপারে কথা হলে ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জিয়াউর রহমান বিপ্লব বলেন, সিটি নির্বাচনের আগে চলাচলের উপযোগী রাস্তাগুলো কেটে ড্রেন ও সংস্কারের কাজ হাতে নিয়ে এখন তা বন্ধ থাকায় প্রায়ই বাসিন্দারা অভিযোগ নিয়ে আসছেন। শুনেছি যে পর্যন্ত কাজ হয়েছে, সেই পর্যন্ত নাকি বিল নিয়ে গেছে ঠিকাদার। কিন্তু সেখানেও নাকি সমস্যা রয়েছে। যে কাজ বাস্তবে হয়েছে তার থেকে বেশি বিল নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। আবার ড্রেনগুলো যে মানের হওয়ার কথা ছিল তাও হয়নি। এখন নতুন মেয়র চেয়ারে না বসা পর্যন্ত এগুলোর কাজ শেষ করা আর সম্ভব নয়। ভোগান্তি নিরসনে তাই আরও কিছুটা সময় লাগবে।
মেয়াদ শেষের পাঁচ দিন আগে দায়িত্ব ছেড়েছেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। একই দিনে পাঁচ বছর পর বিসিসির উন্নয়নে একনেকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে সাতশ’ ৯৭ কোটি টাকা। আনন্দ মিছিল করেছে নগরবাসী। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন নতুন মেয়র খোকন আব্দুল্লাহ।পদত্যাগ করে প্যানেল মেয়র গাজী নাইমুল ইসলাম লিটুর হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করেছেন বরিশাল সিটির বিদায়ী মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। পরে তাকে বিদায়ী সংবর্ধনা দেয় সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সিটি করপোরেশন থেকে কালীবাড়ি রোড পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ এতে অংশ নেন।এ দিকে বিদায় দিনেই একনেকে বিসিসির উন্নয়নখাতে ৮শ ৯৭কোটি টাকার অনুমোদন পাওয়ায় আনন্দ মিছিল করে নগরীতে মিষ্টি বিতরণ করেছেন নতুন মেয়র খোকন আব্দুল্লার অনুসারীরা। নতুন মেয়রের হাত ধরে তিলোত্তমা নগরী হওয়ার অপেক্ষা বরিশালবাসীর।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news