বাংলাদেশ ঢাকা

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের সমকামিতা ও ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ক বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক

d8d118b0 b9e7 11ee a99a 2d63d36b3106.jpg
print news

বিবিসি বাংলা : জাতীয় শিক্ষাক্রমের এক পাঠ্যবইয়ে থাকা ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ক অধ্যায় নিয়ে বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন খণ্ডকালীন সাবেক শিক্ষক আসিফ মাহতাবের বক্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে বিতর্ক ও আলোচনা।সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে আসিফ মাহতাবকে ট্রান্সজেন্ডার এবং সমকামিতা বিরোধী বক্তব্য দিতে দেখা যায়। সেসময় তাকে সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের এক অধ্যায়ে ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ক একটি গল্পের পাতা ছিঁড়ে ফেলতেও দেখা যায়।বিতর্কের সূত্রপাত এর পরই।

এরইমধ্যে, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় দর্শন বিভাগের খণ্ডকালীন প্রভাষক ওই শিক্ষকের সাথে চুক্তি বাতিল করেছে।তবে, বিবিসি বাংলাকে মি. মাহতাব বলেছেন, নিজের দেয়া বক্তব্যকে তিনি সঠিক বলে মনে করেন। আইনজীবীদের সাথে ‌আলোচনার ভিত্তিতে তিনি মনে করেন, তিনি “আইনবিরোধী কোনো বক্তব্য দেননি।”তার এসব বক্তব্য ভাইরাল হওয়ার পর বাংলাদেশের ট্রান্সজেন্ডার কম্যুনিটির সদস্যরা বলছেন, তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এমন মন্তব্য মানুষের মধ্যে ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে বিদ্বেষ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

এ পর্যন্ত যা ঘটেছে

ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে শিক্ষকদের একটি সমাবেশে আসিফ মাহতাবকে একটি মঞ্চে দাঁড়িয়ে মাইকে কথা বলতে দেখা যায়।তার পেছনে টাঙানো ব্যানার থেকে জানা যাচ্ছে, সেটি জাতীয় শিক্ষক ফোরামের ‘জাতীয় সেমিনার ২০২৪’ নামক একটি অনুষ্ঠান, যার বিষয়বস্তু লেখা ছিল “বর্তমান কারিকুলামে নতুন পাঠ্যপুস্তক: বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ”।জাতীয় শিক্ষক ফোরাম মূলত ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের একটি প্ল্যাটফর্ম। শুক্রবার ১৯শে জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওই সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে দলটির আমীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিমের নাম ব্যানারে লেখা ছিল।দশ মিনিট দীর্ঘ ভাইরাল ভিডিওতে আসিফ মাহতাবকে কয়েকবারই সমকামিতা এবং ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু নিয়ে বক্তব্য দিতে দেখা যায়।’মানুষ কীভাবে সমকামী হতে পারে’ এবং ‘একটা জাতি..একটা রাষ্ট্র কীভাবে সমকামী হতে পারে’ এমন প্রশ্ন করতে দেখা যায় তাকে।’পাঠ্যপুস্তকে ট্রান্সজেন্ডারের নামে ইসলাম নিষিদ্ধ সমকামিতাকে উৎসাহিত করার’ অভিযোগ করতে দেখা যায় মি. মাহতাবকে।

ভাইরাল ভিডিওর নয় মিনিট ১৩ সেকেন্ডের সময় তাকে একটি বই দেখিয়ে বলতে দেখা যায়, “এইটা পাবলিশড বই, ঘরে ঘরে আছে। যাদের সামর্থ আছে, তারা একটা কাজ করবেন – সেটা হচ্ছে বইয়ের দোকানে যাবেন। এই বইটা আমি ৮০ টাকা দিয়ে কিনছি। বইটা কিনবেন, কিনে এই যে দুইটা পাতা আছে ‘শরীফ শরীফা’, ছিঁড়বেন।”এই সময় তিনি নিজে হাতে থাকা বইটির দুইটি পাতা ছিঁড়ে দেখান।

এরপর তিনি আবার বলেন, “ছিঁড়ার পরে আপনারা বইটা আবার দোকানদারকে দিয়ে দেবেন। দিয়ে বলবেন এটা অর্ধেক দামে বেচো। এতে মানুষের অ্যাওয়ারনেস হবে। অভিভাবকেরা এখন জানেন না, জানবেন।”এক পর্যায়ে তিনি অভিযোগ করেন, “আমাদের দেশে সমকামিতা অবৈধ। কিন্তু এই গল্পের মাধ্যমে সমকামিতাকে বৈধ করা হচ্ছে।”মি. মাহতাব যে ‘শরীফ-শরীফা’র গল্পের উল্লেখ করেছেন, সেটি জাতীয় শিক্ষাক্রমের সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান পাঠ্যবইয়ের একটি গল্প। এতে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সদস্য শরীফা নামে একজনের পরিচয় সম্পর্কে বলা হয়েছে।এই গল্পে সমকামিতা প্রসঙ্গের কোনো উল্লেখ নেই।

অল্প সময়ের মধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যায়, এবং নেটিজেনদের মধ্যে দুইটি ভাগ দেখা যায়। এক পক্ষ সমকামিতা ও ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে বিদ্বেষপ্রসূত বক্তব্য দেয়ার অভিযোগ করে মি. মাহতাবের সমালোচনা করেন।আরেক পক্ষ মি. মাহতাবকে সমর্থন করে বক্তব্য দিতে থাকেন।মি. মাহতাব যে সেমিনারে বক্তব্য দিয়েছিলেন, সেটি শুক্রবারে অনুষ্ঠিত হলেও, মূলত তিনদিন আগে থেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।ওইদিন মি. মাহতাবও নিজের ফেসবুক পেজে সেটি স্ট্যাটাস হিসেবে পোস্ট করেন এবং এরপর একের পর এক স্ট্যাটাস দিতে থাকেন।

এসব পোস্টে বিভিন্ন সময় তাকে ‘নিজের অবস্থানে অনড়’ থাকার আশ্বাস দিতে দেখা গেছে। ফেসবুকেই তাকে ব্র্যাক কর্তৃপক্ষ ‘চাকরিচ্যুত’ করেছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।এদিকে, এই বিতর্কের মধ্যে ২২শে জানুয়ারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় আসিফ মাহতাবের সাথে থাকা চুক্তি নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নেয়।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় যা বলছে

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় সোমবার নিশ্চিত করেছে, মি. মাহতাবের সাথে এই মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয়টির কোনো চুক্তি কার্যকর নেই।তবে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতির বাইরে আলাদা মন্তব্য করতে রাজি হননি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা।সংবাদমাধ্যমে ২২শে জানুয়ারি পাঠানো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, “আসিফ মাহতাব উৎস ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে তার সাথে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন চুক্তি নেই।”বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, “ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মীদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ বজায় রাখার পাশাপাশি, অন্তর্ভুক্তি এবং সহিষ্ণুতা বজায় রাখতে দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”তবে, এর আগের দিন মি. মাহতাব নিজের সামাজিক মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে জানিয়েছিলেন, ২১শে জানুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে তাকে টেলিফোনে পরদিন থেকে না আসার জন্য বলা হয়েছিল, যাকে তিনি ‘চাকুরিচ্যুত’ করা বলে বর্ণনা করেন।আসিফ মাহতাব ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি হিসেবে যোগ দেন। একই বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সেমেস্টারে তিনি খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে ওই নিয়োগ পেয়েছিলেন বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।এদিকে, মঙ্গলবার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী মি. মাহতাবকে চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে ঢাকার মেরুল বাড্ডা ক্যাম্পাসের সামনে মানববন্ধন করে।এ সময় তারা নিজেদের ‘সমকামী-বিরোধী’ পরিচয় দেয়া ব্যানার ও ফেস্টুন বহন করে এবং জাতীয় শিক্ষাক্রমকে বিতর্কিত বলে বাতিলের দাবি জানায়।
আসিফ মাহতাব যা বলছেনবিবিসি বাংলাকে মি. মাহতাব বলেছেন, নিজের দেয়া বক্তব্যকে তিনি সঠিক বলে মনে করেন। নিজের আইনজীবীদের সাথে আলাপের কথা উল্লেখ করে তিনি বলছেন, তিনি “আইনবিরোধী কোনো বক্তব্য দেননি।”তিনি বলেন, “ট্রান্সজেন্ডার মতবাদে আমাদের যুব সমাজকে যাতে ব্রেইনওয়াশ করা না হয়, তাদের জীবন যাতে ধ্বংস করা না হয়- তাদের প্রটেকশনের জন্যই এ বক্তব্য দিয়েছি।”কিন্তু আনুষ্ঠানিক কোনো সভায় জাতীয় পাঠ্যপুস্তকের পাতা ছিঁড়ে ফেলাকে সঠিক কাজ বলে মনে করেন কী-না বিবিসি বাংলার এমন প্রশ্নের জবাবে মি. মাহতাব বলেন, “আমি আমার ল’ইয়ারের সাথে কথা বলেছি, ল’ইয়ার টিমে যারা আছেন তারা বলছেন এখানে কোনো ল ব্রেক হয়নি।””এ রকম প্রতিবাদের অনেক প্রিসিডেন্স আছে। সারা বিশ্ব জুড়েই প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে পতাকা ছিঁড়ে ফেলার ঘটনাও আছে। আমি দুইটা পাতা ছিঁড়ে প্রতিবাদ করতেই পারি, আমার লইয়ার টিমের ভাষ্য অনুযায়ী এখানে কোনো আইন ভঙ্গ করা হয়নি”

ট্রান্সজেন্ডাররা যা বলছেন

ট্রান্সজেন্ডার নারী ও অ্যাকটিভিস্ট হো চি মিন ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, শিক্ষক আসিফ মাহতাবের বক্তব্য ভাইরাল হয়ে পড়ার পর থেকেই তাদের কম্যুনিটিতে নতুন করে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে।বুধবার তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেছে প্রতিটা মানুষ। আমিও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। এমন মন্তব্য মানুষের মধ্যে ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে বিদ্বেষ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে”।তিনি বলেন, “এরা দলবদ্ধ হয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এরা প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে, ধর্মীয় নেতাদের কাছে যাচ্ছে,তাদের বুঝাচ্ছে যে বাংলাদেশে সমকামিতা ছড়াচ্ছে। এটাতো সমকামিতা না। এটা ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু। এটা তাদের বিশাল বড় উদ্দেশ্য।””এই দলগুলোয় নারী নীতি যখন হচ্ছিলো নারী – পুরুষের সমানাধিকারের বিপক্ষে ছিলো। এটার পেছনে তাদের একটা পলিটিক্যাল স্ট্যান্ড তাদের আছে। এটা মানুষের কাছে পরিষ্কার হতে হবে,” তিনি বলেন।এই বইয়ের দু’টি পৃষ্ঠা প্রকাশ্যে ছিড়ে ফেলেছিলেন শিক্ষক আসিফ মাহতাব

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড যা বলছে

বিতর্কের কেন্দ্র হয়ে ওঠা পাঠ্যপুস্তকের গল্পটি নিয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা এনসিটিবি বলছে, পাঠ্যক্রমের যেকোনো বিষয়বস্তু বা শিক্ষাসূচী প্রয়োজনীয় গবেষণা এবং বারংবার পর্যালোচনার পরই ছাপানো হয়।এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “সরকার ট্রান্সজেন্ডারকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তারা সমাজেরই একটা অংশ। এ বিষয়ে বই রিভিউয়ের সময় ইনক্লুুশন স্পেশালিস্ট, জেন্ডার স্পেশালিস্ট ছিলেন। তিনবার বইটি রিভিউ হয়েছে। তারা সবকিছু দেখে বিশ্লেষণ করে দিয়েছেন।””বইতে যা দেয়া হয়েছে, তা সময়ের প্রয়োজন”, বলেন অধ্যাপক ইসলাম।পাঠ্যপুস্তকের পাতা ছিঁড়ে ফেলা নিয়ে তিনি বলেন, “এ নিয়ে কে কী করেছে, তা নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই, এটা সরকার দেখবে।”এদিকে, পাঠ্যপুস্তকের পাতা ছিঁড়ে ফেলাকে আইন বিরুদ্ধ আচরণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।জেন্ডার বিশেষজ্ঞ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক নাসরীন সুলতানা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “পাঠ্যপুস্তকের পাতা ছিঁড়ে ফেলার ঘটনা গর্হিত অপরাধ। কোনা বিষয়ে অভিযোগ বা অসঙ্গতি দেখলে তিনি কারিকুলাম বোর্ডে চিঠি লিখে জানাতে পারতেন।”সেটা না করে (বইয়ের) পাতা ছিঁড়ে ফেলার ঘটনা খুবই অবমাননাকর, এটা খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে”, মন্তব্য করেন সহযোগী অধ্যাপক সুলতানা।

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি প্রকৃতি আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়
সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *