মতামত মিডিয়া

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে অজুহাত আর নয়

prothomalo bangla 2023 03 b370bcfa 524e 4330 9230 b483f647d5d1 Masuk Art 08 03 2023
print news

কামাল আহমেদ : দিন দুয়েক আগে বরিশালের একটি অনলাইন সংবাদ পোর্টালের সম্পাদক মামুনুর রশীদ নোমানী ই-মেইলে আমাকে কিছু নথির কপি পাঠিয়েছেন। নথিটি তাঁর একটি মামলার অভিযোগপত্র। তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলার আসামি। ২০২০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়রের ছবি ধারণ করার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে এ মামলা হয়। ছবিটি প্রকাশ্য স্থানে তোলা এবং জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁর প্রকাশ্য কর্মকাণ্ড জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট হওয়ায় ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রশ্ন ওঠারও কোনো অবকাশ নেই। তবু মামলা হয় এবং তিনিসহ আরও দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। দুই সপ্তাহ জেল খাটার পর তিনি জামিন পান। পুলিশ জব্দ করা ভিডিও ফুটেজ ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠালে ছবিতে কারও চেহারা চেনা না যাওয়ায় অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু এরপরও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।

এর মধ্যে মামুনুরকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিতও করা হয়েছে। তাঁর আশঙ্কা, অভিযোগপত্র দেওয়ার কারণে এখন তাঁকে আর জামিন দেওয়া হবে না এবং বিচার চলাকালে তাঁকে জেল খাটতে হবে। তা ছাড়া রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তির অভিযোগের কারণে মামলায় সুবিচার মিলবে না বলেই তাঁর ভয়। ফরেনসিক রিপোর্টে প্রমাণ না মেলার পরও অভিযোগপত্র দায়েরে সে ইঙ্গিত রয়েছে বলেই তাঁর ধারণা।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সুবিচার না পাওয়ার আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তার সাম্প্রতিক একটি প্রমাণ হচ্ছে রংপুর সাইবার ট্রাইব্যুনালে হিন্দু কিশোর পরিতোষ সরকারের সাজার রায়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আনার এবং তাকে সাজা দেওয়া হয়েছে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর রংপুরের পীরগঞ্জে ফেসবুকে মন্তব্যের অভিযোগে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামায় ৬০টি বাড়িঘরে ভাঙচুর করা হয়। পরিতোষ তখন দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তার কাছ থেকে জব্দ করা মুঠোফোনে ফরেনসিক পরীক্ষায় কোনো প্রমাণ উদ্ধার করতে পারেনি এবং সে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছিল। কিন্তু তারপরও তাকে দোষী সাব্যস্ত করে দণ্ড দেওয়া হয়েছে। নেতৃস্থানীয় মানবাধিকার সংগঠক, অধ্যাপক সি আর আবরার ডেইলি স্টার পত্রিকায় লিখেছেন, পরিতোষের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ ঘটেছে। সাম্প্রদায়িক হামলার জন্য দায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে একই কারাগারে আটক রাখায় নিরাপত্তার অজুহাতে পরিতোষকে আট মাস নির্জন কক্ষে বন্দী রাখা হয়েছিল বলেও কারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

ওপরের ঘটনা দুটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সম্ভাব্য অপপ্রয়োগে কী ধরনের ভোগান্তি হয়, তার নজির। যেসব অভিযোগে ওই মামলা দুটি হয়েছে, তার বেলায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিদ্যমান ধারাগুলো প্রয়োগের বিষয়ে দেশের মানবাধিকারকর্মী ও নাগরিক সংগঠনগুলো শুরু থেকেই উদ্বেগ ও আপত্তি জানিয়ে আসছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থা, অফিস অব দ্য হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস (ওএইচসিএইচআর) ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যেসব অংশের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, তা সংশোধনের সুপারিশ করেছে, তার মধ্যেও ওই সব ধারার কথা আছে। প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে ওএইচসিএইচআর গত মাসের মাঝামাঝি জানিয়েছিল যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের জন্য তারা বাংলাদেশ সরকারের কাছে যে সুপারিশমালা পেশ করেছে, তা মূলত তিনটি বিষয়ে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যে ভিন্নমত দমন এবং রাজনৈতিক হয়রানির পছন্দের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, তা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের বাইরে অন্য কারও মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যেও অনেকে গোষ্ঠীগত ও উপদলীয় দ্বন্দ্বে এই হাতিয়ারের অপপ্রয়োগের ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। শুরুতে বরিশালের সাংবাদিক মামুনুরের যে মামলার কথা বলেছি, ওই মামলাতেই যুবলীগের একজন নেতা তাঁর সহ-অভিযুক্ত। আইনটি তৈরি হওয়ার আগেই সম্পাদক পরিষদের কাছে আইনমন্ত্রী ও তখনকার তথ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন যে নিবর্তনমূলক ধারার বিষয়ে তাঁদের প্রস্তাব বিবেচনায় নেওয়া হবে। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনী মৌসুমে তড়িঘড়ি করে কোনো পরিবর্তন ছাড়াই তা পাস করা হয়।

বিষয়গুলো হলো ভিন্নমত প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা, কথিত অপরাধ প্রতিরোধের ক্ষমতার পরিধির ব্যাপকতা এবং জামিন ছাড়া দীর্ঘ সময়ের বন্দিত্ব। উদাহরণ হিসেবে বিদ্যমান আইনের ২৮ ধারার কথা উল্লেখ করে সংস্থাটি জানায়, ‘ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুভূতিতে আঘাত হানে—এমন তথ্য প্রকাশের জন্য যে কেউ অপরাধী গণ্য হবে’, এমন বিধান সমস্যাপূর্ণ। পুলিশ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ, ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সিকে (ডিএসএ) দেওয়া ক্ষমতার পরিধি নিয়ে তাদের উদ্বেগ তুলে ধরতে গিয়ে আইনের ৮ নম্বর ধারার কথা উল্লেখ করা হয়। ওই ধারায় বলা হয়েছে, ‘ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের বা উহার কোনো অংশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ন করে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঞ্চার করে’—এমন কাজ অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের তৃতীয় ক্ষেত্রটি হচ্ছে জামিন-অযোগ্য ধারাগুলো এবং বিচারপূর্ব বন্দিত্ব। ওএইচসিএইচআরের মুখপত্রের কথায়, ‘যেসব অপরাধ অজামিনযোগ্য, সেগুলোর মানে হচ্ছে বিচারের আগেই দীর্ঘ বন্দিত্ব।’ আইনে ‘অপরাধের আমলযোগ্যতা ও জামিনযোগ্যতা’ উপশিরোনামের ৫৩ ধারায় মোট ১৪টি ধারা অজামিনযোগ্য হিসেবে নির্দিষ্ট করা আছে। এগুলো হচ্ছে: ধারা ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪। আইনটি জারির পর থেকে এ পর্যন্ত দায়ের হওয়া অধিকাংশ মামলাই হয়েছে এসব অজামিনযোগ্য ধারায়।

 

আরও পড়ুন…..

Bangladeshi journalist Mamunur Rashid Nomani faces hearing over Digital Security Act charges

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনা ও সমস্যাপূর্ণ বিধিবিধান সংশোধনের দাবির মুখে সরকার প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়নে তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশ সফরের সময়ে আগের হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত বলেছিলেন যে তাঁর দপ্তর সরকারের কাছে আইনটি সংশোধনে সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা পেশ করেছে। তিনি তখন ওই সুপারিশ অনুযায়ী আইনটি সংশোধনের জন্য সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে একান্তে কথা বলেছিলেন জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনেও প্রকাশ্য আহ্বান জানিয়েছিলেন।

কিন্তু গত কয়েক মাসে মন্ত্রীদের অনেকে এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বিভিন্ন পরিসরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে অপরিহার্য হিসেবে তুলে ধরায় সোৎসাহে সোচ্চার হয়েছেন। জঙ্গিবাদ ও সাইবার অপরাধের যেকোনো ঘটনার ক্ষেত্রেই এ আইনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। ফলে আইনটি আদৌ সংশোধন করা হবে কি না, সে প্রশ্নে সংশয় তৈরি হয়েছে। এ পটভূমিতে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ওএইচসিআর সরকারের কাছে যা দিয়েছে, তা সুপারিশমালার খসড়া, চূড়ান্ত কিছু নয়। তিনি আরও বলেন, ওই সুপারিশমালার খসড়া নিয়ে তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আলোচনা অব্যাহত রয়েছে, আরও আলোচনার জন্য সময় চাওয়া হয়েছে। ওএইচসিআর সময় দিলে আলোচনা হবে।

আরও পড়ুন…..

Bangladeshi journalist Mamunur Rashid Nomani harassed following 2020 assault, detention

 

আইনমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর দুই সপ্তাহ পার হয়নি। কিন্তু মঙ্গলবার জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক নতুন হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক বলেছেন, তাঁর দপ্তরের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর তিনি বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের আহ্বান জানাচ্ছেন। তাঁর কথায় কোনো অস্পষ্টতা নেই; বরং সরকারের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা শেষ হওয়ার কথা আছে। তিনি আরও বলেছেন, যারা তাদের স্বাধীন মতপ্রকাশ ও বিশ্বাসের অধিকার প্রয়োগ করছে, তাদের বিরুদ্ধে এ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে ফৌজদারি সাজা দেওয়া অব্যাহত রয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যে ভিন্নমত দমন এবং রাজনৈতিক হয়রানির পছন্দের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, তা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের বাইরে অন্য কারও মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যেও অনেকে গোষ্ঠীগত ও উপদলীয় দ্বন্দ্বে এই হাতিয়ারের অপপ্রয়োগের ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। শুরুতে বরিশালের সাংবাদিক মামুনুরের যে মামলার কথা বলেছি, ওই মামলাতেই যুবলীগের একজন নেতা তাঁর সহ-অভিযুক্ত। আইনটি তৈরি হওয়ার আগেই সম্পাদক পরিষদের কাছে আইনমন্ত্রী ও তখনকার তথ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন যে নিবর্তনমূলক ধারার বিষয়ে তাঁদের প্রস্তাব বিবেচনায় নেওয়া হবে। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনী মৌসুমে তড়িঘড়ি করে কোনো পরিবর্তন ছাড়াই তা পাস করা হয়। তারপর থেকেই বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে। চার বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে, এখন আর অপেক্ষার কোনোই যুক্তি নেই। ভিন্নমত দমনের পছন্দনীয় হাতিয়ারটি যদি রেখে দেওয়ার বাসনাই থাকে, তাহলে তা স্পষ্ট করে বলার সততাও থাকা দরকার।

● কামাল আহমেদ সাংবাদিক

 

https://www.prothomalo.com/opinion/column/hqo1ze2i78

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *