অনুসন্ধানী সংবাদ

চট্টগ্রাম বিভাগীয় কারা হাসপাতালে সুস্থ রোগীতে গমগম

1
print news

টাকায় নাকি বাঘের চোখও মেলে! চট্টগ্রামের প্রভাবশালী বন্দি আসামিরা ‘বাঘের চোখ’ না কিনলেও টাকা খরচা করে কিনছেন রাজকীয় জীবন। রোগী সেজে কারা হাসপাতালকে বানিয়েছেন আরাম-আয়েশের ঠিকানা। হাসপাতালে ভর্তি থাকার কথা রোগশোকে বিধ্বস্ত মুমূর্ষু রোগীর। পিলে চমকানো তথ্য হলো, চট্টগ্রামে ১০০ শয্যার বিভাগীয় কারা হাসপাতালটি সুস্থ রোগীতে গমগম। প্রতি মাসে হাজার বিশেক টাকা খরচ করলেই মেলে ‘সুস্থ বন্দি রোগীর’ সিট। এর পর খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে সবকিছুতেই রাজসিক কাজকারবার। হাসপাতালটি ঘিরে মাসে লাখ লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে  অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। এখানে ভর্তি থাকা দুই-তৃতীয়াংশ রোগীই অর্থ আত্মসাতের দায়ে বন্দি আসামি।

বিশেষ করে চেক প্রতারণা মামলার আসামিদের ‘সেভ হোম’ এটি। তারা মাসিক ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকার চুক্তিতে ভর্তি থাকছেন হাসপাতালে। আদালত যখনই কোনো প্রভাবশালী কিংবা বিত্তবান ব্যক্তিকে জেলে পাঠান, তারা টাকা ঢেলে রোগী সেজে উঠে যান হাসপাতালে। তেমনই একজন চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য খাদিজাতুল আনোয়ার সনির খালু ও চেক প্রতারণা মামলার সাজা পাওয়া আসামি ইকবাল চৌধুরী। তিনি ছিলেন দিব্যি সুস্থ! তবু গেল ৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়েই ২১ হাজার টাকা ঘুষে কারা হাসপাতালের সিট বরাদ্দ নেন তিনি। পরের মাসে ফের হাসপাতালে থাকার জন্য ১৮ হাজার টাকা দেন। আরামে দুই মাস কারা হাসপাতালে কাটান তিনি। টাকার বিনিময়ে তাঁকে এই অনিয়মের পথ দেখান সাবেক বেসরকারি কারা পরিদর্শক আবদুস সবুর লিটন। তবে লিটন টাকার বিনিময়ে বন্দি ইকবালকে কারা হাসপাতালে তুলে দেওয়ার কথা অস্বীকার করেন।

শুধু ‘সুস্থ’ বন্দি ইকবাল নন; চিকিৎসকের সঙ্গে লাখ টাকা চুক্তিতে এক বছর কারা হাসপাতালে ভালো সময় কাটিয়েছেন চট্টগ্রামের একাধিক ব্যাংকের ৪০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে মেরে দেওয়া নূরজাহান গ্রুপের পরিচালক টিপু সুলতান। তিনি ২০২২ সালের ১ অক্টোবর কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই ভর্তি ছিলেন এই হাসপাতালে। অসুস্থ না হয়েও দিনের পর দিন হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় আয়েশি কারাভোগ করেন রোগী সেজে।

এদিকে, অসুস্থ না হয়েও প্রভাবশালীর সুপারিশ ও টাকা দিয়ে কারা হাসপাতালে সুসময় কাটছে চেক প্রতারণা মামলার আসামি সীতাকুণ্ড উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থ সম্পাদক মো. আলাউদ্দিন, মো. ইফতেখার, আহমেদ নেওয়াজ, মো. জাফরউল্লাহ, হাসনাইন হারুন, শামীম আহম্মদ, খন্দকার লতিফুর রহমান আজিম, হাবিব হোসাইন ওরফে মিরাজ, কাজী রাকিব উদ্দিন, আশরাফদ্দৌলাসহ ১৪ জনের। জানা যায়, তদবিরে প্রতি সপ্তাহে হাসপাতালে রোগী সেজে ৮ থেকে ১০ জন করে বন্দি ভর্তি হন।

কারা হাসপাতালে রাজকীয় কারবার

পিয়ন থেকে কোটিপতি বনে যাওয়া চট্টগ্রামের পদ্মা অয়েল কোম্পানির সিবিএ নেতা নাছির উদ্দিন দুদকের মামলায় ৯ জানুয়ারি কারাগারে যাওয়ার পরদিনই রোগী সেজে সোজা ওঠেন কারা হাসপাতালে। যদিও ওই দিন তাঁর সঙ্গে আদালত থেকে কারাগারে যাওয়া ৬১ আসামির আর কারও কপালে কারা হাসপাতালের সিট জোটেনি! নাছিরকে হাসপাতালে কারাভোগ করার সুযোগ করে দেন চট্টগ্রাম কারাগারের ঠিকাদার মো. নাছির। এ ব্যাপারে ঠিকাদার নাছির বলেন, সিবিএ নেতা বন্দি নাছির আমার পরিচিত। তাঁকে কারা হাসপাতালে সিট দেওয়ার জন্য আমি তদবির করিনি। তবে ঠিকাদার নাছিরই তদবির করে সিবিএ নেতা নাছিরকে হাসপাতালে তুলেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন কারা হাসপাতালের এক কর্মচারী।

সিবিএ নেতা নাছির উদ্দিনের মতো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সন্দ্বীপের মগধরা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সামছুল আলমের ছেলে রবিউল আলম সমীরকে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর জেলা গোয়েন্দা পুলিশ অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে। ২ জানুয়ারি কারাগারে যাওয়ার পর সন্দ্বীপের এমপির নাম করে জোর তদবির চালান সাবেক কারা পরিদর্শক আরিফুল ইসলাম। এই এক সুপারিশেই ওই ‘সুস্থ সন্ত্রাসী’র ঠিকানা হয়ে যায় কারা হাসপাতাল। ২০ জানুয়ারি এমপি মাহফুজুর রহমান মিতা ও সাবেক পরিদর্শক আরিফুর রহমান কারাগারে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে শারীরিক খোঁজখবরও নেন।

গত ১৭ জানুয়ারি কারাগারে যাওয়ার পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ইনচার্জ ডা. খোকন চৌধুরী তাঁর ভাই প্রবীর চৌধুরীকে কারা হাসপাতালে নিতে জোর তদবির চালান। অসুস্থ না হলেও ১৮ জানুয়ারি থেকে আসামি প্রবীরকে কারা হাসপাতালে আরামে রেখেছে কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রামের স্থানীয় এক কথিত সাংবাদিকের তদবিরে ভুজপুরের বাসিন্দা মো. রাসেল নামে আরেক সুস্থ বন্দিকে ১৮ জানুয়ারি থেকে কারা হাসপাতালে থাকার সুযোগ করে দেয় কারা কর্তৃপক্ষ।

ভাগ্যবান শ্বশুর

চেক প্রতারণা মামলায় সাজা পেয়ে কারাগারে বন্দি হন মো. ইফতেখার। ২০২৩ সালের ২ মে আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠান। এর পর তাঁর জামাতা অতিরিক্ত পোস্টমাস্টার জেনারেল মামুনুর রশীদ শ্বশুরকে কারাগারের সাধারণ ওয়ার্ডের বদলে কারা হাসপাতালে নিতে উঠেপড়ে লাগেন। তাঁর ‘কড়া’ তদবিরে হার মানে কারা কর্তৃপক্ষ। আট মাস সুস্থ বন্দি ইফতেখার কারা হাসপাতালে অসুস্থ রোগী সেজে কারাভোগ করে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে অতিরিক্ত পোস্টমাস্টার জেনারেল মামুনুর রশীদ বলেন, ‘আমার শ্বশুর কিডনি রোগী। তিনি খুবই অসুস্থ। তাই হাসপাতালে রাখা হয়েছে। তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও চিকিৎসা নিতে হয়েছে। তবে কারা হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, বন্দি ইফতেখার কারা হাসপাতালে আট মাস ভর্তি থাকার মতো রোগী নন। উনার মেয়েজামাইয়ের চাপে তাঁকে কারা হাসপাতালে রাখতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ।

শক্তিশালী সিন্ডিকেট, বাণিজ্যের বড় জাল

চট্টগ্রাম কারাগারে সুস্থ বন্দিকে টাকার বিনিময়ে কারা হাসপাতালে পাঠিয়ে আরাম-আয়েশে রাখার মূল কারিগর যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া দুই কয়েদি। তারা হলেন সাবেক দুই চিফ রাইটার মাসুদ পারভেজ ও মাজহারুল ইসলাম। একসময় হাসপাতালের চিফ রাইটার থাকার কারণে কারাগারের ভেতর তাদের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে বিশাল এক সিন্ডিকেট। এ দলে আছেন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি হাতকাটা সোহেল, সেলিম, খোরশেদ, দীপু, শাহেদ ও ভোলা। কারাগারে পাঁচ হাজার বন্দির মধ্যে তারা মূলত অনিয়মের জাল বিছিয়েছেন। জেলে যাওয়ার পর কোনো বন্দি হাসপাতালে থাকতে চাইলে তারাই সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, অফিস স্টাফ, কারারক্ষী ও কারা গোয়েন্দাকে (পিআইও) নির্দিষ্ট হারে ভাগ দিয়ে মিলেমিশে দুর্নীতির এই দুষ্টচক্র সচল রাখা হয়েছে। এমন অনিয়মের তথ্য যাতে আইজি (প্রিজন্স) সিকিউরিটি সেলে না যায়, সে জন্য মাসিক ২০ হাজার টাকা কারা সিআইডি (পিআইও) সদস্য মো. কাউসার আহম্মেদের পকেটে যায়। যদিও পিআইও সদস্য কাউসার কারা হাসপাতাল থেকে মাসোহারা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন।

কারাগারের বাইরেও হাসপাতালে টাকার বিনিময়ে সুস্থ বন্দিকে ওঠানো-নামানোর একাধিক এজেন্ট সক্রিয়। এই অপকর্মের সঙ্গে সাবেক চার বেসরকারি কারা পরিদর্শকও যুক্ত রয়েছেন। তারা চট্টগ্রামের মন্ত্রী ও এমপির নাম বিক্রি করে হাসপাতালে বন্দিদের ওঠানো-নামানোর তদবির করেন।

কে কী বলছেন

কারা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, কিছুদিন আগে এমপি খাদিজাতুল আনোয়ার সনির খালু কারাবন্দি ইকবাল টাকা দিয়ে কারা হাসপাতালে এক মাস বন্দি ছিলেন। পরের মাসে টাকা দিলেও তাঁকে হাসপাতাল থেকে নামিয়ে দেওয়ার একটি অভিযোগ পেয়ে তা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি। আসলে ধারণক্ষমতার বেশি হওয়ায় কিছু অনিয়ম হচ্ছে। আমি অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিই।

কারা হাসপাতালের সহকারী সার্জন ডা. রেজা মো. সরোয়ার আকবর বলেন, কারা হাসপাতাল নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমি সঠিক ব্যক্তি নই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বললে প্রকৃত তথ্য ও বক্তব্য পেতে পারেন। কারা হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. তুষার কান্তি নাথ বলেন, আমি প্রতিদিন চিকিৎসা দিতে কারা হাসপাতালে যাই। সেখানকার অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে বক্তব্য নিতে হলে সিনিয়র জেল সুপারের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেনকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি।
তবে চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার এমরান হোসেন মিঞা বলেন, কারা হাসপাতালে অসুস্থ বন্দিদের ভর্তি রাখার এখতিয়ার শুধু চিকিৎসকের। কোন বন্দি হাসপাতালে থাকবে, কোন বন্দি থাকবে না– সে সিদ্ধান্ত কারা কর্তৃপক্ষ নেয় না; চিকিৎসকরা নেন।

সূত্র: সমকাল

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি প্রকৃতি আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়
সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *