অনুসন্ধানী সংবাদ

সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পদের পাহাড় যুক্তরাজ্যে

saifuzzaman choudhury 20240220212039
print news

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো ২০১৬ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে প্রায় ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের ৩৫০টিরও বেশি সম্পত্তির রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের এক এলাকায় ২০২২ সালে ১ কোটি ১০ লাখ পাউন্ডে একটি প্রোপার্টি বিক্রি হয়। ব্রিটেনের বিখ্যাত রিজেন্টস পার্ক এবং লর্ডস ক্রিকেট স্টেডিয়াম থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে অবস্থিত যুক্তরাজ্যের রাজধানীর সবচেয়ে দামি এলাকাগুলোর একটি ওই এলাকা। সেখানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে কিছু সাদা রঙের বিলাসবহুল বাড়ি। এই এলাকার বাড়ির বিক্রির বিজ্ঞাপনে দেওয়া ছবিতে দেখা যায়, বাড়ির জানালা মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বিস্তৃত। সর্পিল আকৃতির সিঁড়ি বেয়ে ওঠা যায় কয়েক তলা পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, সেই বাড়িতে আছে সিনেমা হল এবং জিমনেসিয়ামও।

বর্তমানে এই বাড়ির বাজারমূল্য ১ কোটি ৩০ লাখ পাউন্ডের বেশি। বাড়িটির মালিক বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। যুক্তরাজ্যে প্রায় ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের ৩৫০টিরও বেশি সম্পত্তি নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য। রোববার মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের বিশেষ এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশি এই রাজনীতিবিদের বিশাল সাম্রাজের ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়েছে।

যুক্তরাজ্যে কোম্পানি হাউসের করপোরেট অ্যাকাউন্ট, বন্ধকি চার্জ এবং এইচএম ল্যান্ড রেজিস্ট্রি লেনদেনের ওপর ভিত্তি করে ব্লুমবার্গ সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পদের এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে।

গত ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পাঁচ বছর ভূমিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী। এবারের নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে পুননির্বাচিত হলেও মন্ত্রিসভায় জায়গা পাননি। তবে সংসদীয় জমি সংক্রান্ত কমিটির সভাপতির পদে আছেন তিনি। ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সাল থেকে তার মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো যুক্তরাজ্যে প্রায় ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের ৩৫০টিরও বেশি সম্পত্তির রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে।

সেন্ট্রাল লন্ডনের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে টাওয়ার হ্যামলেটসে আবাসন— যেখানে ইংল্যান্ডের বৃহত্তম বাংলাদেশি কমিউনিটির আবাসস্থল এবং লিভারপুলে শিক্ষার্থীদের আবাসিক ভবন পর্যন্ত রয়েছে। যুক্তরাজ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর প্রায় আড়াইশ প্রোপার্টির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে ব্লুমবার্গ। এতে দেখা যায়, তার মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো যখন এসব প্রোপার্টি কেনে, তখন ব্রিটেনজুড়ে ভয়াবহ আবাসন সংকট চলছিল। তার কেনা বাড়ির প্রায় ৯০ ভাগই ছিল নবনির্মিত।

saifuzzaman choudhury uk property 20240220211643

আর এসব লেনদেন এমন এক সময়ে ঘটেছিল, যখন রাশিয়ার ধনকুবেররা যুক্তরাজ্যে তাদের সম্পদ সহজে লুকিয়ে রাখতে পারছেন বলে তীব্র সমালোচনা চলছিল। এমন সমালোচনার মুখে যুক্তরাজ্য সরকার সম্পত্তির বিদেশি মালিকানাকে আরও স্বচ্ছ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ইউক্রেনে মস্কোর ২০২২ সালের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রক্রিয়া আরও জরুরি হয়ে ওঠে।

রাজনীতিবিদদের সম্পৃক্ততা আছে এমন লেনদেন যাচাইয়ের ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের আইন আদৌ কার্যকর কি না; সাইফুজ্জামান চৌধুরীর এসব সম্পত্তি কেনার ঘটনায় তা নিয়ে পুনরায় প্রশ্ন উঠতে পারে বলে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনকারীরা বলেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনেও সাইফুজ্জামান চৌধুরীর অন্তত পাঁচটি প্রোপার্টির সন্ধান পেয়েছে ব্লুমবার্গ। সেখানকার মিউনিসিপ্যাল প্রোপার্টির রেকর্ডস অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রায় ছয় মিলিয়ন ডলারে কেনা হয়েছে এসব সম্পত্তি।

গত ডিসেম্বরে প্রাক-নির্বাচনী ঘোষণায় সাইফুজ্জামান চৌধুরী তার মোট সম্পদের পরিমাণ ২৫৮ দশমিক তিন মিলিয়ন টাকা (২ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার) এবং তার স্ত্রী রুখমিলা জামানের মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৯ লাখ ৯৩ হাজার ডলার বলে জানান। বাংলাদেশে সম্পদের ঘোষণাপত্রে তার যুক্তরাজ্যের সম্পদের পরিমাণ দেখাননি সাইফুজ্জামান চৌধুরী। ২০২২-২৩ সালে মন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রায় ১০ হাজার পাউন্ড বেতন হিসাবে পান বলে দেখানো হয়েছে।

সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কোনও মন্তব্য করেননি বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক। তবে তিনি বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশে বসবাসরত অবস্থায় একজন ব্যক্তির বিদেশে সম্পদ অর্জনের কোনও বিধান নেই। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী, আমরা ব্যক্তিদের এটা করার অনুমতি দিই না।’’

সাইফুজ্জামান চৌধুরী কিংবা তার স্ত্রী রুখমিলা জামানের কেউই বাংলাদেশের বাইরে সম্পত্তির মালিকানা অথবা এমপির সম্পদের ঘোষণার বিষয়ে মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেননি বলে জানিয়েছে ব্লুমবার্গ।

মার্কিন এই সংবাদমাধ্যম বলছে, ব্রিটেনের ২০১৭ সালের অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং আইনে সংজ্ঞায়িত পলিটিক্যালি এক্সপোজড পারসন (পিইপি) ক্যাটাগরিতে পড়েন সাইফুজ্জামান চৌধুরী। যা যুক্তরাজ্যে ব্যবসায়িক লেনদেনের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির এজেন্ট, ঋণদাতা, প্রোপার্টির আইনজীবী এবং অন্যদের ওপর পিইপি শনাক্ত করার পদ্ধতি হিসেবে কাজ করে। এই ব্যক্তিরা সম্পত্তি কেনার মতো ব্যবসায়িক লেনদেনে নিযুক্ত থাকতে পারলেও তাদের বিষয়ে অতিরিক্ত যাচাই-বাছাই করা হয়।

ব্লুমবার্গ সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর জন্য সম্পত্তি ক্রয়ে জড়িত আর্থিক পরিষেবা এবং আইনি সংস্থাগুলোর সাথে যোগাযোগ করেছে। যে সংস্থাগুলো প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তারা বলেছে, সম্পত্তি কেনার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। তবে বাণিজ্যিক গোপনীয়তা নিয়ে উদ্বেগের কারণে তারা কোনও মন্তব্য দেয়নি।

দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) ২০১৬ সাল থেকে যুক্তরাজ্যজুড়ে প্রোপার্টিতে বিনিয়োগ করা ৬ দশমিক ৭ বিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের ‘‘সন্দেহজনক তহবিল’’ শনাক্ত করেছে। ব্যাপক দুর্নীতি, ঝুঁকিপূর্ণ বিচারব্যবস্থা এবং দুর্নীতি মামলার সাথে যুক্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উচ্চ স্তরের ব্যক্তি ও সম্পদের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যে এই অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে বলে জানায় টিআই।
• রাজনৈতিক উত্থান

সাইফুজ্জামান চৌধুরী তার প্রয়াত পিতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর স্থলাভিষিক্ত হয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন ২০১৩ সালে। এর এক বছর পর তিনি ভূমি প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর নির্মাণ কোম্পানি আরামিট পিএলসি এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসি থেকে পদত্যাগ করেন তিনি।

২০১৪ সালে তিনি গণমাধ্যমের সাথে আলাপকালে বলেছিলেন, ‘‘আমি শূন্য হাতে এসেছি এবং শূন্য হাতেই যাব।’’ ২০১৯ সালে ভূমিমন্ত্রী হিসেবে পদোন্নতি পান সাইফুজ্জামান চৌধুরী; যা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশের কর্পোরেট নথির বিশ্লেষণ করে ব্লুমবার্গ বলছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং তার কিছু আত্মীয় সরাসরি বা সহায়ক সংস্থার মাধ্যমে এক ডজনেরও বেশি কোম্পানির ব্যক্তিগত শেয়ারে মালিক বা নিয়ন্ত্রণকারী হয়ে উঠেছেন। এতে চারটি পাবলিক কোম্পানি রয়েছে; যার মধ্যে আরামিট এবং ইউসিবি রয়েছে। আর এই দুই কোম্পানির সম্মিলিত বাজার মূলধন প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার।

তার স্ত্রী রুখমিলা জামান ইউসিবির চেয়ারম্যান এবং আরামিটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সম্পদের ঘোষণায় সাইফুজ্জামান চৌধুরী এমন কোম্পানির রেফারেন্স অন্তর্ভুক্ত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে; যেখানে তিনি এবং তার স্ত্রীর শেয়ার রয়েছে।

আরামিট এবং ইউসিবিও এই বিষয়ে মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি বলে জানিয়েছে ব্লুমবার্গ।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি সূচকে বিশ্বের ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশ ১৪৯তম স্থানে রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণের জন্য ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পরপরই কঠোর পুঁজি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ। কিন্তু অতি সম্প্রতি কোভিড-১৯ মহামারী, মুদ্রাস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার মারাত্মক প্রভাব পড়েছে রিজার্ভে।

ব্লুমবার্গ বলেছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর কেবল যুক্তরাজ্যে থাকা রিয়েল এস্টেট সম্পদ বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অন্তত ১ শতাংশের সমান।

 

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি প্রকৃতি আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়
সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *