বদলে যাওয়া দেশে পর্যটনের সুযোগ বেড়েছে


অধ্যাপক ড.মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া :
অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত বাংলাদেশে পর্যটনশিল্প খুবই সম্ভাবনাময়। পৃথিবীর যে কোনো পর্যটককে আকৃষ্ট করার মতো সব পর্যটন আকর্ষণীয় উপাদান দেশে বিদ্যমান। অপার সম্ভাবনাময় এ শিল্পকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ অন্যতম প্রধান পর্যটন গন্তব্যে পরিণত হতে পারে। এদেশের মতো ষড়ঋতুর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য পৃথিবীর আর কোথাও নেই। আমাদের আছে মনোরম পাহাড়, আছে নদী, আছে দিগন্তবিস্তৃত ভাটি-বাংলার হাওড়, সর্ববৃহৎ সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, সেন্টমার্টিন, টেকনাফ। আছে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, ময়নামতী বিহার, চট্টগ্রাম ও সিলেটের মনোমুগ্ধকর চা-বাগান আর আদিবাসীদের বিচিত্র জীবনধারা। এছাড়া আছে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, মাধবকুণ্ডের ঝরনাধারা, ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প, রেশমশিল্প, খাদিশিল্প, জামদানি, টাঙ্গাইলের তাঁত, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমবাগান, বাংলার বিচিত্র পেশা, ঐতিহ্যবাহী ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, স্বাধীনতা ও ভাষা আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ভাস্কর্য ও স্থাপনা, চিরসুন্দর গ্রামীণ জনপদ, হাটবাজার, মেলা-কৃষ্টি-কালচার, কৃষক-কৃষানির সংগ্রামী জীবন, ঋতুবরণ ঐতিহ্য, বাংলা নববর্ষের উৎসব। এ সবকিছুই পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের হাকালুকি হাওড় এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ মিঠাপানির জলাভ‚মি। এছাড়া আছে টাঙ্গুয়ার হাওড়, শনির হাওড়, ডিঙ্গাপুতা হাওড়সহ দিগন্তবিস্তৃত হাওড়ের সমাহার।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের মহান স্বাধীনতার পর পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি অনুধাবন করেছিলেন, এ শিল্পের পরিকল্পিত বিকাশের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার পাশাপাশি সারা বিশ্বে বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা, সংস্কৃতি, পুরাকীর্তি ও প্রত্নত্তত্ত্ব, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় জীবনধারা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সফলভাবে তুলে ধরা সম্ভব। পর্যটনের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনুধাবন করেই জাতির পিতা দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পর্যটনকে গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কক্সবাজার ও কুয়াকাটাকে আন্তর্জাতিক পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে তৈরি করার জন্য নানামুখী পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। বর্তমান সরকার দেশের পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন পর্যটন সুবিধা সৃষ্টিতে নানা কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। স্থানীয় কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে সমুন্নত রেখে পর্যটনের উন্নয়নের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করছে পর্যটনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতি এবং দেশীয় ও বিদেশি নাগরিকদের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পর্যটনশিল্পকে পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ ও টেকসই করে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন ইত্যাদি পর্যটনকেন্দ্রে অপরিকল্পিতভাবে হোটেল-মোটেল নির্মাণ বন্ধ করে পর্যটকদের ভ্রমণ পর্যটনকেন্দ্রের ধারণক্ষমতার মধ্যে রাখা এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের স্বার্থে স্থানীয় জনগণ, ব্যবসায়ী ও অন্যান্য অংশীজনকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করতে আন্তর্জাতিক মানের আবাসন ও বিনোদন সুবিধা নিয়ে কক্সবাজারে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক তৈরি করা হচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য বাজেটের আকার চ‚ড়ান্ত করা হয়েছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেট ছিল ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। তা সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১ লাখ ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বেশি। আর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছর ছিল ২ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশে পর্যটনের নতুন আকর্ষণ বদলে যাওয়া আসাম বস্তি-কাপ্তাই সড়ক। পার্বত্য জেলা রাঙামাটির আসাম বস্তি-কাপ্তাই সড়কে ঘুরতে গেলে ঘাড়ের কসরৎ একটু বেশিই হবে। কারণ এ সড়কের একপাশে কাপ্তাই হ্রদের নীল জলরাশি, অন্য পাশে পাহাড়ের অদ্ভুত সবুজ। এ সড়কটি দিয়ে স্বল্প সময়ে রাঙামাটি থেকে কাপ্তাই উপজেলায় যাওয়া যায়। আর এর দুপাশে গড়ে উঠেছে বড়গাঙ, রাইন্যা টুগুন, বেরান্নে লেক এবং বাগী লেক ভ্যালির মতো বেসরকারি পর্যটনকেন্দ্র। সড়কের পাশ ঘেঁষেই বুদ্ধগুরু মহাসাধক সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভান্তে) জন্মস্থান। সেখানে তার নামে প্রতিষ্ঠিত স্মৃতি মন্দিরে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থীর ভিড় জমে। এ সড়কে যেতে যেতেই চোখে পড়বে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস। পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক মানের আবাসন ও বিনোদন সুবিধা নিয়ে কক্সবাজার জেলায় সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। করোনা মহামারির সময় দেশের পর্যটনশিল্প মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে এ শিল্পকে সহায়তা করার জন্য সরকার ১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে। বাংলাদেশে পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোর উন্নয়নে সরকারি অর্থায়নে ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে একটি পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পর্যটনের উন্নয়ন ও বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে ৩৬টি জেলার পর্যটন ব্র্যান্ডিং অনুসারে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার পর্যটন এলাকার ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলো সংরক্ষণে এবং বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান বিষয়ে ডকুমেন্টারি প্রস্তুত করা হচ্ছে। সরকার পর্যটনশিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নকে গতিশীল করতে বহু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। করোনা-পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। ২০২৫ সালের মধ্যে পর্যটনশিল্পের সর্বোচ্চ বিকাশে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। পুরো দেশকে আটটি পর্যটন জোনে ভাগ করে প্রতিটি স্তরে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রথমবারের মতো সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসাবে কক্সবাজারে পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণে ২৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলোয় প্রায় প্রত্যক্ষভাবে বিনিয়োগ হবে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। পরোক্ষভাবে বিনিয়োগ হবে ১ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া সরকারের প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন, আধুনিক হোটেল-মোটেল নির্মাণ, মহেশখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, সোনাদিয়াকে বিশেষ পর্যটন এলাকা হিসাবে গড়ে তোলা, ইনানি সৈকতের উন্নয়ন, টেকনাফের সাবরাংয়ে ইকো ট্যুরিজম পার্ক নির্মাণ, শ্যামলাপুর সৈকতের উন্নয়ন, ঝিলংঝা সৈকতের উন্নয়ন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ, কুতুবদিয়ায় বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের সম্প্রসারণ, চকরিয়ায় মিনি সুন্দরবনে পর্যটকদের গমনের জন্য যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, ডুলাহাজরা সাফারি পার্কের আধুনিকায়ন ইত্যাদি। এছাড়া আরও চারটি নতুন প্রকল্প নিতে যাচ্ছে সরকার। এসব বাস্তবায়ন হলে আগামী দিনে দেশের পর্যটন খাত আরও চাঙা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও পিপিপির মাধ্যমে বিনিয়োগ করা হবে।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কক্সবাজারে যাতায়াত করার জন্য রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চাঁদপুরের মেঘনার চরে গড়ে তোলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটনকেন্দ্র। নির্মাণ শুরু হতে যাওয়া এ পর্যটন প্রকল্পে থাকবে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের জাদুঘর, পানির উপর ভাসমান কটেজ, চার কিলোমিটার দীর্ঘ কেবল কার, ট্রাডিশনাল কটেজ, স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট, পাঁচতারকা হোটেল, থিম পার্ক, রিভারক্রুজ, স্পিডবোট, হেলিকপ্টার, কনভেনশন হল, থিয়েটার, মিউজিয়াম, ইন্টারন্যাশনাল এক্সপো সেন্টার, মার্কেট, জিমনেশিয়াম, ইনডোর ও আউটডোর গেমস, ক্রিকেট অ্যারোনা, সুইমিং ক্লাব, ওয়াটার রাইড, হাসপাতাল, পার্টি সেন্টার, হলি কর্নার, রিসার্চ ইনস্টিটিউট, স্টাফ রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া, অ্যাগ্রিট্যুরিজম, গ্রিনএনার্জি, পর্যটন ডিপ্লোমা কোর্স স্কুল ইত্যাদি। ব্লু রিভার আইল্যান্ড রিসোর্ট অ্যান্ড ট্যুরিজম ক্লাবের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যটনকেন্দ্রে প্রতিদিন লক্ষাধিক লোকের ভ্রমণের ব্যবস্থা এবং ২০ হাজার পর্যটকের রাতযাপনের সুবিধা থাকবে।
বাংলাদেশের সৌন্দর্যে যুগে যুগে বহু পরিব্রাজক ও ভ্রমণকারী মুগ্ধ হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই এ সৌন্দর্যের লীলাভ‚মি বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন সম্ভাবনা অপরিসীম। আমাদের রয়েছে সুবিশাল সমুদ্রসৈকত, পাহাড়, জলপ্রপাত, প্রতœতত্তে¡র প্রাচুর্য, ঐতিহাসিক নিদর্শনসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান, যা পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি আমাদের দেশকে পরিণত করেছে একটি বহুমাত্রিক আকর্ষণসমৃদ্ধ অনন্য পর্যটন গন্তব্যে। সময়োপযোগী ও পরিকল্পনামাফিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এসব পর্যটন স্পট যদি পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা যায়, তাহলে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পে নবদিগন্তের সূচনা হবে।
লেখক : অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া : উপাচার্য , বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়