মতামত

অবন্তিকা বাঁচার জন্য বিচার চেয়ে আড়াই বছর বেঁচে ছিল

runu bilkis 696x666 1
print news

কাজী রুনু বিলকিস :

বইমেলা থেকে কয়েকটি বই আগ্রহ নিয়ে সংগ্রহ করেছিলাম। এত অ–কাজে (?) ব্যস্ত যে পড়তে নিলে আরও অ–কাজের কথা মনে পড়ে যায়! এটা হয়নি ওটা হয়নি! কয়েকদিন ধরে মাথার ভেতর ঘুরছে অবন্তিকা নামটি! কার কবিতায় এই নামটা উচ্চারিত হয়েছিল! সুবোধ সরকার না শক্তির! মনে পড়ছে না। কিন্তু কোথাও কোনো কবিতায় পড়েছি! কি সুন্দর নাম! অবন্তিকা! যার অর্থ হচ্ছে আয়ুস্মান! মেয়েটার নাম শুধু অবন্তিকা নয় আরও একটু দীর্ঘ। ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা। আয়ুস্মান হয়নি সে, চব্বিশে থেমে যাওয়া জীবনের নাম অবন্তিকা। অত্যন্ত প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত মেধাবী মুখ! জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্রী। সে কি নিজেই নিজের জীবন থামিয়ে দিলো নাকি না থামিয়ে আর পেরে উঠছিল না! নাকি তার সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বয়ান দিয়ে গেলো এই মৃত্যুকে ঝাপটে ধরে! এই অবন্তিকা কি একজন? নাকি অসংখ্য অবন্তিকা আমাদের চারপাশ ঘিরে! ঘরে বাইরে যাদের কাছে জীবনটাই এমন মূল্যহীন হয়ে উঠে! শারীরিক অসুস্থতা বাইরে প্রকাশ পায় কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের কোনো প্রতিকার অন্তত এদেশে নেই! কারণ এটা দৃশ্যমান নয়। জীবন্মৃত জীবন হয়তো অনেকেই যাপন করছেন মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে। অবন্তিকার আত্মাহুতির পর একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও একটি ছাত্রী মুখ খুলেছে কীভাবে তার জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে এবং তার পড়াশোনা থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন্য তার গ্রামের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে শিক্ষক! এরকম যৌন হেনেস্তার শিকার হয়ে কত শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে তার হিসেব আমাদের কাছে নেই! হারিয়ে যাওয়া কিছু মুখ আজও বুকে তোলপাড় তোলে! স্মৃতির ওপার থেকে ভেসে আসে নামগুলো–তনু, নুসরাত, তিন্নি, হাসি…অনেক নাম তলিয়ে গেছে, এখন আর মনে করতে পারি না! তাদের পরিবার কি বিচার পেয়েছে? মাদ্রাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বত্রই এক শ্রেণির লম্পট–নির্লজ্জ নারী–শিকারী ওঁৎ পেতে থাকে কখনো শিক্ষকের পরিচয়ে, কখনো ছাত্রের পরিচয়ে। শিক্ষা তাদের চরিত্রে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। লাম্পট্যকে তারা শিক্ষার সাথে গুলিয়ে ফেলে। তাদের মন ও মগজে আদিম অন্ধকারে টাসা। এদের জন্য উদার, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমশ নৈতিকতাহীন নির্লজ্জ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। অন্তত গবেষণা তো তাই বলছে। বেশিরভাগ মধ্যেবিত্ত পরিবারের ভুক্তভোগী ছাত্রীরা এসব বিষয়গুলো দাঁতে দাঁত চেপে হজম করে নেয়। তারা সবরকম বিপত্তি এড়িয়ে কোনোরকমে পড়াটা শেষ করতে চায়। যে ১০ শতাংশ বিচারপ্রার্থী নারী শিক্ষার্থী গবেষণায় উঠে আসে তারা কি সত্যি বিচার পান? নাকি আবারও নতুন করে হেনেস্তার শিকার হয়! নাকি উল্টো শিক্ষা জীবনের নানারকম ক্ষতির শিকার হয়! নীতি নৈতিকতাহীন লোভী ক্ষমতার ক্রিম খাওয়া, যাবতীয় অনৈতিক সুবিধা গ্রহণকারীরা ন্যায় বিচারের পক্ষে থাকবে না সেটাই তো স্বাভাবিক! ভাবতেই লজ্জায় মাথা হেট হয়ে আসে দেশে ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত পাঁচ বছরে যৌন হয়রানির ৫১টি অভিযোগ সামনে আসে। এরমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৭টি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০টি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭টি, আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০টি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭টি অভিযোগ–যার কোনোটিরই নিষ্পত্তি হয়নি। চরিত্র হনন ও ন্যায় বিচার না–পাওয়ার আশংকা থেকে ৯২ শতাংশ ছাত্রীরা অভিযোগ থেকে বিরত থাকে। তাছাড়া রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে অভিযুক্তরা পার পেয়ে যায়। শিক্ষকরা তাদের পেশাগত ক্ষমতা ব্যবহার করে টিউটোরিয়াল, উত্তরপত্র ও ভাইভায় নম্বর কমিয়ে দেন বা ফেল করিয়ে দেন। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া ছাত্রীকে বিচার চাইতে গিয়ে ভিকটিম ব্লেমিং–এর শিকার হতে হয় নিজ শিক্ষকদের কাছে! বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই অপরাধগুলো জিইয়ে রেখেছে। দেশের সরকারি বেসরকারি ১৭০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ–সংক্রান্ত কমিটি বা সেল থাকলেও তা শুধু নামেই রয়েছে এর কোন কার্যকারিতা নেই। অবন্তিকা বিচার চেয়ে চেয়ে ক্লান্ত ছিল। উল্টো শিক্ষক তাকে অপমান করেছে। দুই থেকে আড়াই বছর ধরে এই উৎপীড়ন চলে এসেছে। অবন্তিকা একটি সুশিক্ষিত পরিবারের সন্তান। ওর বাবাও একজন সরকারি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। মা–ও আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। অবন্তিকা বেঁচে গেলে দেশের জন্য অবদান রাখতে পারতো। দেশকে কিছু দিতে পারতো হয়তো। একজন মেধাবী ছাত্রীকে এভাবে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে কেউ পার পেয়ে যাক সেটা কারো প্রত্যাশিত হতে পারে না। এ–সব হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত করা হোক যারা তাদের পাশবিক প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করতে অপারগ। তাদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হোক। তাদের মুখোশ উন্মোচিত হোক। ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বাড়ছে, কেন বাড়ছে তার কারণ খুঁজে বের করা হোক। নাকি এটা এই সময়ের সামগ্রিক সমাজচিত্রেরই প্রতিফলন!

অবন্তিকা তার ফেইসবুক আইডিতে এক পোস্টে সুস্পষ্টভাবে নিজের আত্মহত্যার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকীকে দায়ী করে গেছেন। আশা করি অবন্তিকার পরিবার সুবিচার পাবে। অবন্তিকা বেঁচে থাকতে বিচার পায়নি। আড়াই বছর ধরে সে বিচার চেয়েও পায়নি। সুবিচার পেলে হয়তো এই পরিণতি দেখতে হতো না।

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *