সাদিক অ্যাগ্রোর ভয়ানক প্রতারণা : ইমরান যেন মিথ্যার রাজা


ইত্তেহাদ নিউজ,ঢাকা :রাজধানীর আগারগাঁওয়ের প্রাণিসম্পদ মেলায় ১ হাজার ৩০০ কেজি ওজনের ব্রাহামা জাতের একটি গরু নিয়ে এসে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয় সাদিক অ্যাগ্রো। গরুটির দাম হাঁকা হয় ১ কোটি টাকা। বলা হয়, ‘উচ্চ বংশীয় মর্যাদাসম্পন্ন’ হওয়ায় এ গরুর দাম এত বেশি! এরপর চলতি জুন মাসে ঈদুল আজহার সময় ১৫ লাখ টাকায় ছাগল বিক্রির ঘটনা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার সূত্রে জানা যাচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরেই গবাদিপশু নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে ভয়ানক প্রতারণা করে আসছে ঢাকার মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকার এই কোম্পানিটি। এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ইমরান হোসেন যেন মিথ্যার রাজা। সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে পশু আমদানি এবং বিক্রি করলেও তাদের বিরুদ্ধে কখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অভিযোগ উঠেছে, ‘খান্দানি ছাগল’ ‘বংশীয় গরু’, ‘বংশীয় ছাগল’, ‘এই গরুর বাবা, দাদা, দাদার বাবার পরিচয় আছে’- এই ধরনের বক্তব্য দিয়ে প্রতারণা করে আসছে সাদিক অ্যাগ্রো। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে এ কোম্পানিটি দেশের বাইরে থেকে নিয়ে আসছে আমদানি নিষিদ্ধ ব্রাহামা জাতের গরু। ২০১৬ সালে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এই গরু আমদানি নিষিদ্ধ করে। তারপরও ২০২১ সালের জুলাইয়ে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর কাস্টমস যুক্তরাষ্ট্র থেকে অবৈধভাবে আনা ১৮টি ব্রাহামা গরু জব্দ করে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নথিপত্র জাল করে গরুগুলো আনা হয়েছিল। ঢাকা কাস্টম হাউস গরুগুলো অধিদপ্তরে হস্তান্তর করে। এরপর সেগুলো সাভারের কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে রাখা হয়। কিন্তু কৌশলে নিলামে তুলে সেগুলোকে আবারও কিনে নেয় সাদিক অ্যাগ্রো। গরুগুলো ঈদুল ফিতরের সময়েই জবাই করে সুলভ মূল্যে বিক্রির কথা থাকলেও পরে আর বেচা হয়নি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টরা এসব ব্যাপারে এখন মুখে কুলুপ এঁটে আছেন।
গত ঈদুল আজহায় ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল বিক্রি করে তুমুল আলোচনার জন্ম দেয় সাদেক অ্যাগ্রো। প্রতিষ্ঠানটির মালিক ইমরান হোসেন ছাগলটিকে ‘খান্দানি ছাগল’ হিসেবে প্রচার করেন। এই ছাগলের ক্রেতা ছিল কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মতিউর রহমানের ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত। ছাগলকাণ্ডের পর দুর্নীতি-অনিয়মের নানা চালচিত্র উঠে আসতে শুরু করলে মাকে নিয়ে দেশ ছাড়ে ইফাত। এনবিআর ও সোনালী ব্যাংকের পরিচালকের পদ থেকে থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তার বাবা প্রভাবশালী কর্মকর্তা মতিউর রহমানকে। তার অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে তিন সদসের কমিটি গঠন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সাদিক অ্যাগ্রো বিসিএস লাইভ স্টক অ্যাসোসিয়েশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে গেলে, সাদিক অ্যাগ্রো গবাদিপশুর বাজারে যা করছে, সেটাকে কোনোভাবেই ব্যবসা বলা যায় না। তারা ঈদুল আজহার এক-দুই মাস আগে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দেখতে সুন্দর গরু-ছাগল কিনে আনে। সেগুলোকে মোটা-তাজা করার জন্য নানা ধরনের হরমোন পুশ করে কৌশলী কথা বলে বাজারে বিক্রি করে।’
সাদিক অ্যাগ্রোর অবস্থান মোহাম্মদপুরের বছিলা বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকায়। ওই এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শন করে স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, ‘সাদিক অ্যাগ্রো গড়ে তোলা হয়েছে কিছু জমি ভাড়া নিয়ে, কিছু জমি অবৈধভাবে দখল করে। সারা বছর সেখানে হাতে গোনা কয়েকটি গরু থাকে। কিন্তু কোরবানি ঈদের এক-দুই মাস আগে থেকে সেখানে ট্রাকভর্তি গরু-ছাগল আসতে দেখা যায়। এসব গরু চড়া দামে বিক্রি করা হয়।’
নিষিদ্ধ ব্রাহামা গরু বিক্রি করে সাদেক অ্যাগ্রো
এবার কোরবানির ঈদের আগে সাদিক অ্যাগ্রো ২ কোটি ৬০ লাখ টাকায় ব্রাহামা জাতের তিনটি গরু বিক্রি করে। এসব গরুর ক্রেতাদের সঠিক নাম-ঠিকানা প্রকাশ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। সাধারণ গরুর তুলনায় প্রতিষ্ঠানটি কমপক্ষে ১৫ গুণ বেশি দামে ব্রাহামা জাতের গরুগুলো বিক্রি করে থাকে। আমদানি নিষিদ্ধ এই গরু সম্পর্কে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতারণামূলক প্রচারণা চালিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করে। সাদিক অ্যাগ্রোর স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ ইমরান হোসেনের দাবি, তারা এবার মোট তিনটি ব্রাহামা জাতের গরু বিক্রি করেছেন। এগুলোর মধ্যে ১ হাজার ৪০০ কেজি ওজনের একটি গরু বিক্রি হয়েছে কোটি টাকায়।
একজন ক্রেতা এই হিসাব তুলে ধরে বলেন, এর অর্থ প্রতি কেজি মাংসের দাম পড়েছে অন্তত ৭ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘এটা অন্যায় এবং ভোক্তাদের সঙ্গে বড় ধরনের প্রতারণার শামিল। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
সাদেক অ্যাগ্রোর স্বত্বাধিকারী ইমরানও রয়েছেন এমন একাধিক ভিডিওতে দেখা গেছে, কোটি টাকা দামের ব্রাহামা গরু বিক্রির পর ইমরান বলছেন, ‘আজকে সাদিক অ্যাগ্রো থেকে বাংলাদেশের ওয়ান অ্যান্ড অনলি আমেরিকান পাখারা ব্রাহমন, হাইড সুপার ডুপার বিক্রি হলো, ক্রেতা আমাদের বিলাভ-অ্যাট সাকের ভাই। সাকের ভাই এবার হজ পালন করতে যাচ্ছেন। সবাই সাকের ভাইয়ের হজ কবুল হওয়ার দোয়া করবেন। অল দ্য বেস্ট সাকের ভাই। আমিন, ছুম্মা আমিন।’
ভিডিওতে দেখা যায় উল্লেখিত সাকের আহমেদ ব্রাহামা দুইটা গরু (পিয়েল ও কমান্ডো) কিনেছেন। এছাড়া ভিডিওতে তাকে দুটি দুম্বা নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করতে দেখা গেছে। এই সাকের আহমেদ কে তা জানা সম্ভব হয়নি। একটি সূত্র জানিয়েছে, তিনি তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ী, সিআইপি এবং একটি টেক্সটাইলস মিলসের মালিক।
২০২১ সালে বিমানবন্দরে কাস্টমস যে গরুগুলো আটক করেছিল, সেগুলো কীভাবে ইমরানের নিজস্ব খামারে গেল, এমন প্রশ্নের জবাবে সরকারি কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারের কৃত্রিম প্রজনন বিভাগের উপপরিচালক এজেডএম সালাউদ্দিন বলেন, ‘সাদিক অ্যাগ্রো কর্তৃপক্ষ গরুগুলো অনেক আগেই নিয়ে গেছে, এটা ঠিক। তবে কীভাবে এসব গরু নিয়ে গেছে, সেটি আমার জানা নেই।’
সাদিক অ্যাগ্রোর কাছে গরুগুলো হস্তান্তর করা প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারের কৃত্রিম প্রজনন বিভাগের পরিচালক ডা. মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা শহরে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নির্ধারিত ২৫টি স্থানে রমজান মাসে সুলভ মূল্যে মাংস বিক্রির জন্য আমরা একটি প্রশাসনিক নির্দেশনা পেয়ে গরুগুলো হস্তান্তর করেছি। পরে গরুগুলো জবাই করা হয়েছে কি না, সেটি মনিটর করার দায়িত্ব আমাদের না। এ দায়িত্ব প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের।
ছাগল নিয়ে ভয়াবহ প্রতারণা
শুধু গরু নয়, খাসি এবং অন্যান্য গবাদিপশুর বাজারেও নৈরাজ্য ছড়িয়ে প্রতারণা করছে সাদিক অ্যাগ্রো। ৩০ কেজি ওজনের খাসি লাইভ ওয়েটে ৭০০ টাকা ধামাকা অফার দেয় প্রতিষ্ঠানটি। কোরবানির ঈদের সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চাউর হয় ১৮০ কেজি ওজনের ছাগলের ভিডিও। সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে থাকা পশুটি নিয়ে হইচই পড়ে যায়। পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতার খাসিটির দাম হাঁকা হয় ১৫ লাখ টাকা। খাসিটি কেনে কাস্টমস কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত।
সাদিক অ্যাগ্রোর ম্যানেজার জাহিদ হাসান বলেন, ‘খাসিটি দিল্লি থেকে আনা। সচরাচর দেশে এত বড় ছাগল দেখা যায় না, তাই এর দাম অন্যদের তুলনায় কিছুটা বেশি।’ পরে জানা যায়, কোরবানির দুই মাস আগে ছাগলটি যশোরের একটি হাট থেকে কিনে খামারে তোলে সাদিক অ্যাগ্রো। সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান নিজে দাবি করেন, ‘যশোর থেকে ১০ লাখ টাকায় কেনা হয়েছিল ছাগলটি।’ তার এই দাবিও অসত্য ও প্রতারণামূলক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
সাদিক অ্যাগ্রোর প্রতারণার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বলেন, ‘উনি খামারি। তার সঙ্গে আমাদের ডিসকোর্স (নানা বিতর্ক) আছে। তিনিসহ অনেকেরই ব্রাহামার প্রতি আসক্তি আছে। আমরা ব্রাহামা আমদানির পক্ষে নই। কারণ ব্রাহামা দুধ খুব কম দেয়। সাদিক অ্যাগ্রো কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল গবাদিপশু নিয়ে আরও সতর্কভাবে বক্তব্য দেওয়া। তিনি ‘বংশীয়’, ‘খান্দানি’ এসব শব্দ ব্যবহার না করে ‘উন্নত জাত’ বলতে পারতেন। বর্তমান সরকার যেখানে ভোগ্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করছে, সেখানে গরুর এই দাম স্বাভাবিক বাজারমূল্যের মধ্যে পড়ে না। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর মাংসের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরও কম মূল্যে ভ্রাম্যমাণ মাংস বিক্রি করে। সাধারণ মানুষ যাতে সুলভ মূল্যে মাংস কিনতে পারে, এজন্য সরকারের সব ধরনের উদ্যোগ রয়েছে। সাদিক অ্যাগ্রোর এত চড়ামূল্যে গরু বিক্রি কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
সাদিক অ্যাগ্রোর বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘মাংসের এ ধরনের অস্বাভাবিক দাম সাধারণ বাজারে প্রভাব ফেলে। এতে গরুর দাম অস্বাভাবিক রকম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আমরা তাদের বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, ‘এসব পশুর ক্রেতাদের আয়ের উৎস খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কারা এসব পশু এত চড়ামূল্যে কিনছেন, সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এসব ক্রেতার তথ্য যাচাই করতে পারে।’
সাদিক অ্যাগ্রোর স্বত্বাধিকারী ইমরান হোসেন বলেন, ‘আমাদের গবাদিপশুগুলো ছিল উচ্চবিত্তের ক্রেতাদের জন্য। সাধারণ ক্রেতাদের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়বে না। শুধু সামর্থ্যবানরা এ ধরনের গরু কিনবেন।’ গবাদিপশু নিয়ে প্রতারণার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
সৌজন্যে : প্রতিদিনের বাংলাদেশ
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়