প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক চীন সফরের গুরুত্ব


অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া : স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বাংলাদেশ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় সবসময় উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রবর্তিত ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ ভিত্তিক বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদে জাতীয় সার্বভৌমত্ব, শান্তিপূর্ণ বিরোধ নিষ্পত্তি এবং বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর প্রতি সমর্থনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। জাতির পিতার প্রদর্শিত পথেই তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৌশলে বিশ্ব দরবারে পরস্পরবিরোধী শক্তিগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও উন্নয়নের স্বার্থে সুসম্পর্ক বজায় রেখে ‘ভারসাম্যপূর্ণ’ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ভারসাম্যপূর্ণ এ কূটনীতির ফলস্বরূপ আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বাংলাদেশ তার সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। গত মাসে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর এবং বর্তমান চীন সফর কিন্তু বাংলাদেশের ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক সফলতারই ফসল।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের পাশাপাশি চীনের সঙ্গেও বাংলাদেশের পারস্পরিক সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক ক্রমবর্ধমান। ১৯৭৬ সালের প্রারম্ভে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ-চীনের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ অবধি পরস্পরের বন্ধন অধিকতর দৃঢ়তা লাভ করছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক জীবনে চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেছেন। তিনি ১৯৫২ সালের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য চীন সফর করেন। সফরকালে তিনি চীনা বিপ্লবের প্রাণপুরুষ মাও সে তুং ও চৌ এনলাই-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করে। কিন্তু বড় আফসোসের বিষয় যে, চীন-বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠার পূর্বেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। তবে চীন-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের যে বীজ বঙ্গবন্ধুর হাতে রোপিত হয়েছে তা বঙ্গবন্ধুর পদচিহ্ন অনুসরণ করে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে চিরসবুজ হয়েছে। বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধনের মাধ্যমে একজন স্বপ্নদর্শী নেতা হিসেবে নিজের কদর সাবুদ করেছেন। শেখ হাসিনার অগ্রসরমান নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসেবে চীনের পাশাপাশি এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন বাংলাদেশের একটি বড় অংশীদার হিসেবে নিজেকে স্থাপন করেছে।
ফলস্বরূপ, গত মাসের ২১-২২ জুন ২ দিনের ভারত সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের আমন্ত্রণে সম্প্রতি ৮ জুলাই তিন দিনের দ্বিপাক্ষিক সফরে চীন গিয়েছিলেন। চীন সফর শেষে বেইজিং থেকে ইতোমধ্যে ঢাকা ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী। চীনের বেইজিংয়ে প্রধানমন্ত্রী ৮ থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত অবস্থানকালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন এবং প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং-এর সঙ্গে প্রতিনিধি পর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করেন। সফরের শেষ দিন ১০ জুলাই বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও চীনের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একটি প্রতিনিধি পর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর দু’দেশ ২১টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে এবং সাতটি প্রকল্পের ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক ও প্রকল্পের ঘোষণা নিঃসন্দেহে দুই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
অর্থনৈতিক দিক থেকে এ সফর বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত এক দশকে ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে চীন বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী দেশ হয়ে উঠেছে। পদ্মা সেতু ও বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে চীনা অর্থায়ন এবং প্রযুক্তির অবদান রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও মজবুত হওয়ার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের গতি আরও বৃদ্ধি পাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট’-এর তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরে চীনের সঙ্গে যে ২১টি সমঝোতা স্মারক সই ও ৭টি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির ফিজিবিলিটি স্টাডির সমাপ্তি ও দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি চুক্তির মতো বিষয়। চীনের এ নতুন বিনিয়োগের ঘোষণা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক।
অর্থনৈতিক গুরুত্বের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর বাংলাদেশের জন্য বাণিজ্যিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বর্তমানে চীন বাংলাদেশের একক বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ চীনে ৬৭৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে এবং চীন থেকে ২২.৯০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে। প্রধানমন্ত্রী বেইজিংয়ে চীনা ব্যবসায়ীদের বলেন, ‘এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগের উপযুক্ত সময়।’ প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধা এবং এ ব্যাপারে সরকার গৃহীত কার্যক্রমও তুলে ধরেছেন। তাঁর আহ্বানের ফলে চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে দেশের অর্থনীতির জন্য তা অত্যন্ত ইতিবাচক হবে।
অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক গুরুত্বের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের যে ২১টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে তার প্রথম সমঝোতা স্মারকে বলা হয়েছে- চীন বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতিতে সহযোগিতা জোরদার করবে। বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতিতে চীনের সহযোগিতা জোরদার হলে ২০৪১ সালের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার যে ভিশন ও মিশন তা জোরদার হবে। এতে দ্রুততা ও সফলতার সাথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধির পথে।
আমরা সবাই জানি, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। আমরা চীন থেকে আমদানি করি প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের পণ্য আর রপ্তানি করি ৭৫ কোটি ডলারের পণ্য। বিশাল এ বাণিজ্য-ঘাটতি কমিয়ে নিয়ে আসার ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সফর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। চীন সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে এবং বিশাল এ বাণিজ্যি-ঘাটতি অনেকটাই কমে আসবে বলে প্রত্যাশা করছি।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের এতসব গুরুত্বের পাশাপাশি অন্যরকম আরেকটি গুরুত্ব রয়েছে। তা হলো বাংলাদেশের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীনের ভূমিকা। রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের গুরত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সমস্যা, যা সমাধানে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন যাবৎ বহু প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। কিন্তু কোনো সুফল পাচ্ছে না। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কেননা মিয়ানমারে চীনের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে এবং রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীন বাংলাদেশের পাশে থাকবে- এমন একটি বার্তা প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের আগেই চীনের কূটনীতিকদের দেওয়া হয়েছে। সফরকালেও এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বলে ধারণা করছি এবং চীন বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিয়েছে বলেই আশা করছি। এছাড়া শুধু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনই নয়; ভবিষ্যতে তাদের ভরণপোষণের জন্য যে বিপুল অর্থ প্রয়োজন, তাতেও চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশ সহায়তা চাইতে পারে। তবে সেটি অবশ্যই চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্কের ওপর নির্ভর করবে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার এ সফরের মাধ্যমে সে সুসম্পর্কের পথে বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়ে গেল এতে কোনো সন্দেহ নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ এবং চীনের মধ্যকার এ সুসম্পর্ক রক্ষার মাধ্যমে দুই দেশের অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক উন্নয়ন অনেক ত্বরান্বিত হবে।
পরিশেষে বলা যায়, চীন বিশ্বের অন্যতম দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। এতো বড় অর্থনীতির একটি দেশ চীনে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সফর এবং তার সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়ন কখনো খারাপ হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্ব ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞাবলেই কেবল বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দুই দেশ ভারত ও চীনের সঙ্গে এমন ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছে। আমরা আশা করছি, বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব ভারত ও চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে সমানতালে অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন সাধন করে সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশের যে সফল পথচলা তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া: উপাচার্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়,
সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়