জুলাই অভ্যুত্থানের ১ বছর: ফ্যাসিবাদের ছায়া এখনও


রক্ত, মৃত্যু আর ধ্বংস; তার মধ্যেই দ্রোহের আগুন, এক বছর আগে এমন এক সময়ের সাক্ষী হয়েছিল বাংলাদেশ। অভূতপূর্ব এই অভ্যুত্থানে অবসান ঘটে শেখ হাসিনার দেড় দশকের কর্তৃত্ববাদী শাসনের, তাকে ছাড়তে হয় দেশ।
এক যুগ আগের আরব বসন্তের আদলে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে পরিচিতি পায় ‘বর্ষা বিপ্লব’ নামে। আর দেশে ‘জুলাই অভ্যুত্থান’, যদিও এই মাস পেরিয়ে আগস্টের ৫ তারিখে এসেছিল অভ্যুত্থানের বিজয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী নেতৃত্বের মতামতের ভিত্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব।
তার সেই সরকারের এক বছর পূর্ণ হলেও জুলাই যে জনপ্রত্যাশা তৈরি করেছিল, তা পূরণ হয়েছে কি?
জুলাই আন্দোলনের পক্ষগুলোর মধ্যে এখন নানা প্রশ্নে বিভেদের দেয়াল উঠলেও একটি বিষয়ে সবাই বলছেন, মানুষের প্রত্যাশা পূরণ এখনও হয়নি।
নির্বাচন নিয়ে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ধূমায়িত অসন্তোষের মধ্যে আগামী বছরের এপ্রিলে ভোট করার পরিকল্পনা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। বিএনপিসহ অধিকাংশ দল আরও আগে নির্বাচন চাওয়ায় তিনি প্রস্তুতি শেষ হলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বলেছেন।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গে সংস্কারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা জানিয়ে দায়িত্ব নিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়, তাদের প্রতিবেদনও জমা পড়েছে, কিন্তু দৃশ্যমান কোনও সংস্কারে এখন চোখে পড়ছে না।
জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ প্রণয়নের দাবি ছিল আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের। সরকারের ওপর হতাশ হয়ে গত বছরের ডিসেম্বরে তারা নিজেরাই তা ঘোষণা করতে যাচ্ছিল। পরে তাদেরকে থামানো হয় সরকারের পক্ষ থেকে।
তারও সাত মাস পর অভ্যুত্থানে বিজয়ের প্রথম বার্ষিকীর দিন মঙ্গলবার ড. ইউনূস নিজেই জুলাই ঘোষণাপত্র জাতির সামনে উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন। এজন্য ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিতে থাকছে বিশেষ আয়োজন।
জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার ছিল আন্দোলনকারীদের বড় দাবি। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের গড়া দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি হুমকি দিয়ে আসছে, বিচারের আগে নির্বাচন নয়।
অভ্যুত্থানের বছর পূর্তির ঠিক আগে গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা, তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সেই সময়কার পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিচার শুরু হয়েছে। ভারতে থাকা শেখ হাসিনাকে পলাতক দেখিয়েই চলবে এই বিচার।
তাপরও অভ্যুত্থানের সরকার নিয়ে অসন্তুষ্টি রয়েছে অভ্যুত্থানকারীদেরই। এনসিপির সাম্প্রতিক জুলাই পদযাত্রার সমাবেশ থেকে খোলাখুলিভাবেই এসেছে সেই সমালোচনা।
আর যার নেতৃত্বে দ্রোহযাত্রা থেকে গত বছরের ২ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি প্রকাশ্যে তোলা হয়েছিল, সেই আনু মুহাম্মদও অন্তর্বর্তী সরকারের কাজে দেখছেন ক্ষমতাচ্যুত সরকারের ‘ছায়া’।
তিনি সম্প্রতি এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেছেন, “সেই একই রকম স্বৈরতন্ত্র, একই রকম জনগণের ওপর বিভিন্ন ধরনের নিপীড়ন, একই রকম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা হচ্ছে।”
কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে অভ্যুত্থান
৩৬ দিনের আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালে হাই কোর্টের এক রায় থেকে।
তার আগে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধাসহ সব কোটা তুলে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
গত বছরের গত ৫ জুন হাই কোর্টের এক রায়ে কোটা পুনর্বহাল হলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবার ক্ষোভ দেখা দেয়। আগের বার ‘সাধারণ শিক্ষার্থী অধিকার পরিষদ’ ব্যানারে আন্দোলন হলেও এবার ব্যানার বদলে হয় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’।
শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহবাগকে কেন্দ্র করেই চলছিল শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি। প্রায় প্রতিদিন শাহবাগে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছিল তারা। ধীরে ধীরে আন্দোলনের পরিসরও বাড়তে থাকে।
তবে আন্দোলন চাঙা হয়ে ওঠে ১৪ জুলাই শেখ হাসিনার এক বক্তব্যে। চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সেই সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, “মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদের এত ক্ষোভ কেন? (চাকরি) মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে?”
তার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সেই বিক্ষোভ থেকে স্লোগান ওঠে- ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার-রাজাকার’।
পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হামলা চালালে সারাদেশে শিক্ষাঙ্গনে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটে। পরদিন বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। তাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ ছাত্রলীগ-যুবলীগের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে বিক্ষোভকারীদের।
১৬ জুলাই ঢাকায় দুজন, চট্টগ্রামে তিনজন এবং রংপুরে একজন নিহত হয়। রংপুরে নিহত আবু সাঈদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক ছিলেন। পুলিশের গুলির মুখে তার প্রতিরোধের ছবি জুলাই আন্দোলনের প্রেরণা হয়ে ওঠে।
এদিকে কোটা পুনর্বহাল করে হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন করে সরকার। কিন্তু তাতে বিক্ষোভ থেমে থাকেনি। ১৭ জুলাই জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে আন্দোলনকারীদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছিলেন শেখ হাসিনা, কিন্তু তাতে সাড়া না দিয়ে পরদিন ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
তখন সরকার সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে, মোবাইল ইন্টারনেটও দেয় বন্ধ করে। তার মধ্যেই ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে ব্যাপক সহিংসতায় কমপক্ষে ৪১ জন নিহত হয়। রামপুরায় বিটিভি ভবন, বনানীতে সেতু ভবন, মহাখালীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
এই পরিস্থিতি দেখে সারাদেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটও বন্ধ করে দেয় সরকার। আন্দোলনকারীদের আলোচনার প্রস্তাব দেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তা নাকচ করে আন্দোলন চালিয়ে যেতে অনড় থাকেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা।
এর পরের কয়েকটি দিন ব্যাপক সংঘাত হয় দেশজুড়ে। তাতে কয়েকশ জন নিহত হয়। ঢাকায় মেট্রোরেলের মিরপুর ১০ নম্বর ও কাজীপাড়া স্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতা।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই সারাদেশে কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েন করে সরকার। কারফিউ ভেঙেই বিক্ষোভ চলতে থাকে। সরকার তখন সাধারণ ছুটিও ঘোষণা করে।
২১ জুলাই কোটা পুনর্বহাল নিয়ে হাই কোর্টের রায় বাতিল করে আপিল বিভাগ। ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা, ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের কোটা রেখে বাকি ৯৩ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের আদেশ দেওয়া হয়।
কিন্তু তখন কোটার আন্দোলন হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবির আন্দোলনে রূপ নেয়। চার দফা দাবি তুলে ধরে সরকারকে আলটিমেটাম দেয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
২৩ জুলাই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সীমিত আকারে চালু করা হয়। কারফিউ শিথিল করে সীমিত পরিসরে অফিস-আদালত খুলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে সরে আসার আহ্বান জানায় সরকার। কিন্তু শিক্ষার্থীরা অটল থাকে আন্দোলনে।
২৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও আবু বাকের মজুমদারকে তুলে নিয়ে যায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তবে অন্য সমন্বয়করা কর্মসূচি চালিয়ে যান, তারা ২৮ জুলাই গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখন কর্মসূচির ডাক দেন।
এই আন্দোলনে নতুন মাত্রা দিয়েছিল গ্রাফিতি; প্রতিবাদের এমন রূপ বাংলাদেশে আগে কখনও দেখা যায়নি। তাতে আরেক মাত্রা যোগ হয় ফেইসবুকে প্রোফাইল পিকচার লাল করার মাধ্যমে।
আন্দোলন দমনে গণগ্রেপ্তার চলতে থাকে; তার প্রতিবাদে ৩১ জুলাই ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি ডাকে শিক্ষার্থীরা। আর শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধ মিছিলে জনতার অংশগ্রহণও বাড়তে থাকে।
আন্দোলনের চাপে আটক করে রাখা সমন্বয়কদের মুক্তি দেয় পুলিশ। সেই দিনই আনু মুহাম্মদের নেতৃত্বে দ্রোহযাত্রা কর্মসূচি থেকে সরকারকে পদত্যাগের আহ্বান জানানো হয়।
সমন্বয়কদের মুক্তির পর ৪ আগস্ট থেকে অনির্দিষ্টকালের সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তার আগের দিন ৩ আগস্ট আন্দোলনকারীদের সরাসরি আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, গণভবনের দরজা খোলা। তার পাল্টায় শহীদ মিনারের সমাবেশ থেকে সরকার পতনের ১ দফা দাবি তোলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
৪ আগস্ট দেশব্যাপী ব্যাপক সহিংসতায় শিক্ষার্থী, পুলিশ সদস্যসহ প্রায় ১০০ জন নিহত হয়। তার মধ্যেই সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন জানান সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়াসহ অবসরপ্রাপ্ত একদল সেনা কর্মকর্তা।
৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি দিয়ে সবাইকে রাজধানীতে রওনা হতে বলেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কিন্তু সেই কর্মসূচি একদিন এগিয়ে ৫ আগস্ট নিয়ে আসা হয় ৪ আগস্টের ঘোষণায়।
তখন সরকার আবার অনির্দিষ্টকালের কারফিউ জারি করে। নাশকতা কঠোর হাতে দমনের নির্দেশ দেন শেখ হাসিনার। শিক্ষার্থীদের বাইরে বের হতে না দিতে অভিভাবকদের প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে বার্তা দেওয়া হয়।
কিন্তু কোনোকিছুতেই কাজ হয়নি। থমথমে এক অবস্থা নিয়ে শুরু হয়েছিল ৫ আগস্টের সকাল। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা ও উত্তরায় সংঘর্ষ বাধে। দুপুরের আগে সড়ক পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে। তখন বিভিন্ন দিক থেকে শাহবাগের দিকে ছুটতে শুরু করে মিছিল। সেই মিছিল এগোতে থাকে বিনা বাধায়।
দুপুরের পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সংবাদ সম্মেলন করে জানান, রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এরমধ্যে খবর আসে বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের রওনা হয়েছেন শেখ হাসিনা। সারাদেশ তখন ফেটে পড়ে উল্লাসে। গণভবন, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে পড়ে জনতা। বিজয় হয় অভ্যুত্থানের।
গণআন্দোলনে পতনের পর এই প্রথম কোনও রাষ্ট্রনেতাকে পালাতে দেখল বাংলাদেশ। একটানা ১৫ বছর দেশ শাসন করছিলেন শেখ হাসিনা। কঠোর হাতে বিরোধী দলকে দমন করে তকমা পেয়েছিলেন ‘আয়রন লেডি’; আর চলে যাওয়ার সময় জনতার স্লোগান শুনতে হলো- ‘এক, দুই, তিন চার-শেখ হাসিনা স্বৈরাচার’।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সরকারহীন, পুলিশহীন দেশে অরাজকতা চলতে থাকে। বিভিন্ন স্থানে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ চলে। জনরোষে পোড়ে থানাগুলো। আক্রান্ত হয় সারাদেশের আওয়ামী লীগ কার্যালয়, দলটির নেতাদের বাড়ি-অফিস।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা জানান শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হবে। তাদের প্রস্তাব মেনে নেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান হিসাবে ড. ইউনূসের ৬ মাসের সাজা হয়েছিল। তা বাতিল করে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল।
৭ আগস্ট ফ্রান্স থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন ড. ইউনূস। পরদিন দুপুরে তিনি শাহজালাল বিমানবন্দরে নামলে তাকে স্বাগত জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। এরপর রাতেই বঙ্গভবনে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসসহ ১৪ জন উপদেষ্টাকে শপথ পড়ান রাষ্ট্রপতি।
‘জুলাই আমাদের সবার’
এক বছর পর বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে মতভেদ যখন পাল্টাপাল্টি আক্রমণে গড়াচ্ছে, তখন অভ্যুত্থানের ‘মাস্টারমাইন্ড’ মাহফুজ আলম বলেছেন, “জুলাই আমাদের সবার।”
সোমবার এক ফেইসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, “দলীয় বা আদর্শিক বিরোধের জেরে জুলাই গণ- অভ্যুত্থানে কারও অবদান অস্বীকার করা উচিৎ না।”
বিভিন্ন দল ও সংগঠনের ভূমিকা নিয়ে মাহফুজ বলেছেন, “এখানে শিবির ভূমিকা রেখেছে তাদের ‘জনশক্তি’ ও কো-অর্ডিনেশন দিয়ে। বিভিন্ন প্লাটফর্ম থেকে শিবিরের কর্মীরা অভ্যুত্থানকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, ক্ষেত্র বিশেষ চালিয়ে নিয়ে গেছেন। ছাত্রদল ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ফ্যাসিস্ট বাহিনীকে প্রতিরোধ করেছে, প্রতিরোধ স্পটগুলোতে লড়াই করেছে, তৃণমূলে লীগকে প্রতিরোধ করেছে।
“ছাত্রশক্তি কো-অর্ডিনেট করছে মাঠে-সামনে থেকে, সিভিল সোসাইটি আর কালচারাল সার্কেলে এবং আস্থা তৈরি করতে পেরেছে। ছাত্র অধিকার পরিষদের কর্মীরা সারাদেশে প্রতিরোধ গড়েছেন এবং আগের কোটা আন্দোলনের লড়াইয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন।”
“ছাত্র ইউনিয়নের একাংশ, ছাত্র ফেডারেশন ও অন্যান্য বাম ছাত্র সংগঠনগুলো মাঠ ও বয়ান ধরে রাখছে, বামপন্থী সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো জুলাইয়ের শেষ দিনগুলোতে মাঠে নেমে জনগণের মধ্যে সাহস সঞ্চার করেছে। আলেম ও মাদ্রাসা ছাত্ররা রাজপথে নেমে দীর্ঘসময় প্রতিরোধ ধরে রেখেছিলেন। যাত্রাবাড়ী যার উজ্জ্বল উদাহরণ।”
আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের একটা অংশ বিদ্রোহ করে অভ্যুত্থানে যুক্ত হয়েছিলেন বলেও দাবি করেন মাহফুজ।
বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ নিয়ে মাহফুজ লিখেছেন, “শ্রমজীবীরা এবং প্রাইভেটের শিক্ষার্থীরা প্রতিরোধের স্পটগুলোতে দীর্ঘসময় লড়াই করেছে, রিক্সাচালক ও নিম্ন, নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষেরা প্রতিরোধ গড়েছেন। নারীরা রাজপথে লড়েছে এবং আহতদের সহযোগিতা করেছে। অভিভাবক বিশেষ করে মায়েরা, বোনেরা কারফিউর দিনগুলোতে এবং জুলাইয়ের শেষ থেকে রাস্তায় নেমে সাহস জুগিয়েছেন।
“স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রতিরোধের স্পটগুলোতে নিজেরাই নেতৃত্ব দিয়ে অভ্যুত্থান এগিয়ে নিয়ে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাংবাদিক সমিতি ও অন্যান্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন অভ্যুত্থানের পক্ষে নীরব অথচ কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে।
“উঠতি মধ্যবিত্ত জুলাইয়ের শেষদিকে নেমে অভ্যুত্থানকে আরও ব্যাপক করেছেন। পেশাজীবী সংগঠনগুলো এবং সাংস্কৃতিক ও মিডিয়া কর্মীরা জুলাইয়ের শেষদিকে একাত্মতা প্রকাশ করে অভ্যুত্থানকে শক্তিশালী করেছেন। প্রবাসী শ্রমিক, চাকুরে এবং প্রফেশনালরা জুলাইকে, বাংলাদেশের লড়াইকে বৈশ্বিক করতে ভূমিকা রেখেছেন। কবি, সাহিত্যিক, পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল, সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার এবং র্যাপাররা জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছেন, অনুপ্রাণিত করেছেন।”
এদিকে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে আসার আগে প্রধান উপদেষ্টার ফেইসবুক পেইজে এক পোস্টে বলা হয়, “ছত্রিশ জুলাই- গত বছর এই দিনে পৃথিবী দেখেছিল এক অভাবনীয় গণ-অভ্যুত্থান। যার ফলে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো ফ্যাসিস্ট।
“এক বছর পর আবার ফিরে এসেছে ছত্রিশ জুলাই। এই দিনে ঘোষিত হতে যাচ্ছে জাতির আকাঙ্ক্ষিত ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’। এই উপলক্ষে সারাদিনব্যাপী আয়োজন থাকছে মানিক মিয়া এভিনিউজুড়ে। আসুন আমরা সবাই পরিবার পরিজন নিয়ে যোগ দেই ‘ছত্রিশ জুলাই’ উদযাপনে। আমাদের ইতিহাস, আমাদের গৌরব।”
‘ফ্যাসিবাদের ছায়া এখনও’
‘দ্রোহযাত্রার’ বর্ষপূর্তিতে গত শনিবার ‘ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর বিলোপ, চব্বিশের গণহত্যাসহ পাহাড় ও সমতলের সব গণহত্যার বিচার এবং নব্য ফ্যাসিবাদী প্রবণতা প্রতিহতের’ আহ্বানে ‘শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার দ্রোহযাত্রার’ আয়োজন করা হয়।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সেই কর্মসূচির সমাবেশে আনু মুহাম্মদ বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তাতে আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের ওপরে শেখ হাসিনা সরকারের ছায়া দেখতে পাচ্ছি। সেই একই রকম স্বৈরতন্ত্র, একই রকম জনগণের ওপর বিভিন্ন ধরনের নিপীড়ন, একই রকম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা হচ্ছে।”
বিভিন্ন নাগরিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আসা এই অধ্যাপক বলেন, “চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, ইউনূস সরকারের প্রতি জনগণের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, একের পর এক সেই প্রত্যাশা ভঙ্গ করে এই সরকার এক বছর পার করেছে।
“এই সরকার যে অনেক কিছু করতে পারবে না, সেটা আমরা বুঝি। রাতারাতি পরিবর্তন তাদের কাছ থেকে আমরা প্রত্যাশাও করি না। কিন্তু আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম পরিবর্তনের সূচনা। যেটা হয়নি।”
মব সন্ত্রাস ঠেকাতে ব্যর্থতা, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গোপনীয়তার চুক্তির সমালোচনা করে তিনি বলেন, “এই যে তৎপরতা চলছে, এটা তো গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যাশার বিপরীত যাত্রা। সরকার এই উল্টোযাত্রা যদি করতে থাকে, তাহলে জনগণের দ্রোহযাত্রা তো অবশ্যই অব্যাহত রাখতে হবে।”
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে সবার ওপরে রাখার ওপর জোর দিয়ে আনু মুহাম্মদ বলেন, “যারা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করে দেখাতে চায়, তারা গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিপক্ষ শক্তি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আওয়ামী লীগের সম্পত্তি নয়। তাদের কবল থেকে মুক্তিযুদ্ধকে উদ্ধার করে জনগণের মালিকানায় নিয়ে আসতে হবে।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।