ইসলামী ছাত্র শিবির এবং এনসিপির মধ্যে বিরোধ কেন


বিবিসি : বাংলাদেশে এক বছর আগে শেখ হাসিনার পতন আন্দোলনে গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে একসাথে কাজ করলেও ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাথে নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির নেতাদের সম্পর্কের টানাপোড়েন এখন অনেকটাই প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে।
উভয় সংগঠনের নেতাদের পরস্পরবিরোধী মন্তব্য সামাজিক মাধ্যমে আলোচনার ঝড় তুলছে এবং এর জের ধরে তাদের কর্মী সমর্থকদেরও পরস্পরের বিরুদ্ধে বাহাসে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে।
দু’পক্ষের নেতাদের সাথে কথা বলে যে ধারণা পাওয়া গেছে, তাহলো- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই তাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি বা বৈরিতার সূচনা হয়েছে এবং এটি সামনে আরও প্রকট হয়ে উঠতে পারে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ৯ই সেপ্টেম্বর ডাকসু নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হওয়ার কথা রয়েছে।
এছাড়াও গত বছর জুলাইয়ে শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনের সফলতার কৃতিত্ব ছাড়াও আন্দোলনের পরবর্তী রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েও উভয় সংগঠনের মধ্যে গত কিছুদিন ধরে মতবিরোধ প্রকাশ হতে দেখা যায়।
শিবিরের নেতারা অবশ্য বলছেন, নিজেদের লাইমলাইটে আনার জন্য এবং আসন্ন ডাকসু নির্বাচনে ‘সুবিধা নেওয়ার’ জন্য তাদের সংগঠন ও নেতাদের টার্গেট করে কথা বলছে এনসিপি।
রোববার ঢাকায় এনসিপির সমাবেশে জনসমাগম তুলনামূলক কম হয়েছে দাবি করে অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছেন যে, শিবির লোকবল পাঠায়নি বলেই এমন অবস্থা হয়েছে।
বিবিসি বাংলার সাথে আলাপকালে এনসিপির একজন শীর্ষ নেতা এমন ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে একে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনৈতিক প্রচারণা বলে দাবি করেছেন। একই সঙ্গে তিনি শিবিরের বিরুদ্ধে একপাক্ষিক প্রচারণার (আন্দোলনের কৃতিত্ব নিয়ে) অভিযোগ করেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, আন্দোলনের সময় এক থাকলেও এখন যার যার রাজনীতিই নিজেদের কাছে বড় হয়ে ওঠেছে বলেই শিবির ও এনসিপির মধ্যে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনের প্লাটফরম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিলো, তাতে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা সমন্বয়ক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। এর একটি অংশ শিবিরের সাবেক নেতা ছিলেন।
আন্দোলন সফল হওয়ার পর আরও অনেকের নাম উঠে আসে নেপথ্যে থেকে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য। ওই সময়েই নাহিদ ইসলামদের সাথে থাকা আবু সাদিক কায়েম আলোচনায় উঠে এসেছিলেন।
সাদিক কায়েমকে শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত দিনগুলোতে ও সেই সরকারের পতনের পর প্রেস ব্রিফিংয়ে নাহিদ ইসলামদের সাথেই বিভিন্ন কর্মসূচিতে দেখা গেছে। তারও কয়েকদিন পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সভাপতি হিসেবে নিজের পরিচয় প্রকাশ করে আলোচনায় এসেছিলেন।
পরে ‘তিনিই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন কিংবা তিনি নীরবে নিভৃতে কাজ করে গেছেন’- সম্প্রতি এমন প্রচারণা শুরু হলে তা নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করেন নাহিদ ও তার সঙ্গে এনসিপির বড় একটি অংশ।
এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় গত ৩১শে জুলাই দেওয়া এক পোস্টে শিবির নেতা সাদিক কায়েমকে নিয়ে একটি মন্তব্য করেন, যা নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে।
তিনি তার পোস্টে লিখেছেন “সাদিক কায়েম বৈষম্যেবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সমন্বয়ক ছিলনা। কিন্তু পাঁচই অগাস্ট থেকে এই পরিচয় সে ব্যবহার করেছে। অভ্যুত্থানে শিবিরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে সাদিক কাইয়ুমকে প্রেস ব্রিফিং এ বসার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সাদিক কাইয়ুমরা অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ঢালাও প্রচারণা করেছে এই অভ্যুত্থান ঢাবি শিবিরই নেতৃত্ব দিসে”।
নাহিদ ইসলামের পোস্টকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমে বাদানুবাদে লিপ্ত হয় উভয় পক্ষের কর্মী সমর্থকরা। শিবির সমর্থকরা শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে ‘সাদিক কায়েমের অবদান’কে তুলে ধরে এনসিপির নেতাদের সমালোচনা করছেন।
আবার নাহিদ ইসলাম ও এনসিপির সমর্থকরা শিবির নেতা বা কর্মী অনেকের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের সাথে থেকে আওয়ামী লীগ আমলে ‘কিভাবে হলে হলে নির্যাতন নিপীড়ন করেছে’ সেই বর্ণনা তুলে ধরছেন সামাজিক মাধ্যমে।
গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আহবায়ক আব্দুল কাদের ফেসবুকে লিখেছেন “অভ্যুত্থান পরবর্তীতে জামাত শিবিরের পক্ষ থেকে ঢাবি শিবিরের একজন সাবেক সভাপতি এবং এক শিবির নেতার বউ মূলত এই হিস্যার বিষয়টা ডিল করতেন। সচিবালয় থেকে মন্ত্রণালয়, আমলাতন্ত্রের সব জায়গায় নিজেদের মতাদর্শী লোকজন বসানোর ক্ষেত্রে লিঁয়াজো করেছেন মূলত এই দুই ব্যক্তি (আমি যতদূর জানি)”।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক সংগঠনই হলো গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ। আর এনসিপি হলো তাদের মূল রাজনৈতিক দল।
সাদিক কায়েম নিজেও ফেসবুকে এসবের জবাব দিয়েছেন। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেছেন, হয়তো তারা (এনসিপি)কারও ফাঁদে পড়েছে কিংবা কারও দ্বারা প্ররোচিত হয়েছে।
“আমরা তাদের কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ আশা করেছিলাম। আমরা সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনা করছি। হয়তো এতে তারা থ্রেট ফিল করছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।
ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি নূরুল ইসলাম বলছেন, ডাকসু নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজেদের লাইমলাইটে আনার জন্যই শিবির ও এর নেতাদের নিয়ে এসব বলা হচ্ছে।
“সাময়িক ফায়দা লোটার জন্যই এই রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত কাজ করছে তারা। আমরা কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগসহ নানা বিষয় থাকা সত্ত্বেও শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতারা এগুলো নিয়ে কিছু বলছি না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
অবশ্য এনসিপি নেতারা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলছেন, তার দলের আহবায়ক নাহিদ ইসলাম কোনো সংগঠন বা এর কোনো শীর্ষ নেতাকে নিয়ে কোনো আপত্তিকর মন্তব্য করেননি।
“এখানে মনকষাকষি বা দহরম মহরমের বিষয় নেই। বরং যেভাবে আন্দোলন নিয়ে একপাক্ষিক প্রচারণা করা হচ্ছে সেটাই তুলে ধরেছেন এনসিপি আহবায়ক। রাজনৈতিক দল ও সংগঠন পরস্পরের বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলা অন্যায় কিছু নয়,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন আখতার হোসেন।
এনসিপির কর্মসূচিতে জামায়াত শিবির লোকবল সরবরাহ না করায় তারা ক্ষুব্ধ হয়েছেন- এমন অভিযোগও প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি। “এই প্রচারণা নিতান্তই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমরা সারাদেশে সাধারণ মানুষের সমর্থন পাচ্ছি,” বলছিলেন তিনি।
তবে সংগঠন দুটির নেতাদের সাথে আলোচনা করে যে ধারণা পাওয়া গেছে, তা হলো শিবিরের হয়ে সাদেক কায়েম ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থী হবেন- এমন সম্ভাবনা থেকেই এনসিপির একাংশ তার বিরুদ্ধে ফেসবুকে সরব হয়েছে।
শিবিরের কেউ কেউ এমন ধারণা দিয়েছেন যে, ডাকসু নির্বাচনে এনসিপির পক্ষ থেকে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ যে প্যানেল দিবে সেটিকে এবার শিবির সমর্থন করুক বা প্যানেল ভাগাভাগিতে এগিয়ে আসুক- এমনটিই চাইছে এনসিপির নেতৃত্ব।যদিও আখতার হোসেন বলছেন, তারা নিজেদের কর্মী ও সমর্থকদের ওপরই নির্ভর করছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, আন্দোলনের পর নিজেদের রাজনীতিই দল বা রাজনৈতিক সংগঠনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
“বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সবাই ছিলো। এখন সবাই যার যার রাজনীতি করছি। সে জন্যই কখনো সখ্য কখনো বিবাদ দেখা গেছে। জাতীয় নির্বাচন যতই এগিয়ে আসবে এনসিপি ও জামায়াত-শিবিরের মধ্যে এই বাহাস কিংবা মতবিরোধ আরও বাড়বে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।