শেখ হেলাল গড়েছেন সম্পদের পাহাড়


সাবেক সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিন আওয়ামী লীগের বড় কোনো নেতা ছিলেন না। বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সামান্য একজন সদস্য হলেও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই হওয়ার কারণে দলে তাঁর দাপট ছিল ব্যাপক।
খুলনা অঞ্চলে আওয়ামী লীগের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ, মনোনয়ন বাণিজ্য, চাকরি, বদলি, ঠিকাদারি, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু চলত তাঁর কথায়। শেখ হেলাল দোর্দণ্ড প্রতাপ খাটিয়ে কয়েকটি জেলায় নামে-বেনামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তাঁর ভাই ও সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সালাহ উদ্দিন জুয়েল এবং ছেলে ও সাবেক সংসদ সদস্য শেখ তন্ময়।
শেখ হেলাল বাগেরহাট-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য ছিলেন ছয়বার, যদিও তাঁর বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। খুলনা নগরীতেও রয়েছে তাঁর বাড়ি। তবে বেশির ভাগ সময় তিনি থাকতেন ঢাকার বাড়িতে। শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই হওয়ার কারণে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ এ অঞ্চলে আওয়ামী লীগের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর মূল পদে কে থাকবেন, তা নির্ধারণ করে দিতেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, টাকার বিনিময়ে ভালো পদ দেওয়া হতো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী জানান, সংসদ সদস্য, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউপি চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা অঢেল টাকা দিতেন শেখ হেলালকে। তিন জেলায় সরকারি দপ্তরের উচ্চ পদে বদলি হয়ে আসার জন্যও মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হতো তাঁকে। চাকরিতে নিয়োগ, সুবিধাজনক জায়গায় বদলি– সবকিছুর জন্যই দিতে হতো টাকা।
বড় বড় ঠিকাদারি কাজ কে পাবে, ব্যবসা-বাণিজ্য কে কোথায় করবে, ব্যবসায়িক সংগঠনগুলোতে কে নেতা হবেন, তার সবকিছুই নির্ধারণ করে দিতেন শেখ হেলাল। শেখ হেলালের অবৈধ সম্পদের এই সাম্রাজ্য দেখাশোনা করতেন তাঁর ভাই খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সালাহ উদ্দিন জুয়েল, যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সোহেল, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন মালিক গ্রুপের সাবেক সহসভাপতি শেখ জালাল উদ্দিন রুবেল, শেখ বাবুসহ তাঁর পিএস, এপিএস ও সাঙ্গোপাঙ্গ।
লোকমুখে শোনা যায়, শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে উত্তাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে দেশ ছাড়েন শেখ হেলাল। ৫ আগস্ট সরকার পতনের কয়েক দিন আগেই খুলনার বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান তাঁর চার ভাই ও পরিবারের অন্য সদস্যরা।
রাজধানীর বনানী বাণিজ্যিক এলাকার ১৭ নম্বর সড়কের ১১ নম্বর বাড়ি র্যাংগস প্যারামাউন্ট-১-এ শেখ হেলালের অফিস। তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম খানজাহান আলী পরিবহন।
গত সংসদ নির্বাচনের সময় জমা দেওয়া হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, শেখ হেলাল ব্যবসা থেকে বছরে আয় দেখান ৫০ লাখ টাকা, সংসদ সদস্য হিসেবে ভাতা ২৪ লাখ টাকা। ব্যবসা থেকে বছরে তাঁর স্ত্রী শেখ রূপার আয় সাড়ে ২৯ লাখ টাকা।
অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে নিজের নামে তিনটি গাড়ি, নগদ টাকা, ব্যাংকে জমা, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, আসবাবসহ সব মিলিয়ে প্রায় ৮ কোটি ৮২ লাখ টাকার এবং স্ত্রীর নামে ৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।
স্থাবর সম্পদের মধ্যে পূর্বাচল নতুন শহরে ১০ কাঠা জমি, নরসিংদীর পলাশ উপজেলার কাজৈর মৌজায় ১ একর ৬৭ শতক জমির মূল্য ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, পিলজং মৌজায় ১০৯ শতক জমির মূল্য ৫৫ লাখ টাকা, কাজৈর মৌজায় ১৮২ শতক জমির মূল্য ৭১ লাখ টাকা, গুলশান বারিধারা আবাসিক এলাকায় ৫ কাঠা জমির ওপর সাততলা আবাসিক ভবনের মূল্য ১০ কোটি ১৭ লাখ টাকা, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় সাড়ে ১৪ শতক জমি।
স্ত্রীর নামে নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার কাজৈর মৌজায় ১ হাজার ৩২২ শতক জমির মূল্য দেখিয়েছেন ১ কোটি ৯ লাখ টাকা। তবে হলফনামার এসব তথ্য অসম্পূর্ণ বলে দলের লোকজন জানান। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে আরও অনেক সম্পদের মালিক শেখ হেলাল ও তাঁর চার ভাই।
শেখ জুয়েল সম্পদ
শেখ হেলালের ভাই খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সালাহ উদ্দিন জুয়েলের বার্ষিক আয় ৭ কোটি ২৯ লাখ টাকা। বাড়ি ভাড়া, কার্গো জাহাজের ব্যবসা, শেয়ার, ব্যাংকের মুনাফাসহ বিভিন্ন খাত থেকে তিনি এই আয় দেখিয়েছেন। তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের বছরে আয় ৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
তাঁর ব্যাংকে জমা ১৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, ১ কোটি টাকার এফডিআর, তিনটি কোম্পানির শেয়ার আছে ২১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, ২৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, ৮৫ লাখ টাকা মূল্যের জিপ গাড়ি, ৭৯ লাখ টাকা মূল্যের ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও আসবাব এবং কার্গো ব্যবসায় তাঁর বিনিয়োগ ১৪ কোটি ২১ লাখ টাকা। স্ত্রী শম্পা ইয়াসমিনের নামে ব্যাংকে ১৪ কোটি টাকা, ২৩ কোটি ২৬ লাখ টাকার শেয়ার, ২৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, ১ কোটি টাকা মূল্যের জিপ গাড়ি, ১৩ লাখ টাকা মূল্যের স্বর্ণালংকার।
তাঁর স্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে– রাজধানীর পূর্বাচল নিউ টাউনে ১০ কাঠা জমি। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া ও খুলনার দিঘলিয়ায় তাঁর ৪ দশমিক ৪১ একর জমি রয়েছে। রাজধানীর গুলশান নিটল মডেল টাউন, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁওয়ে রয়েছে তিনটি ফ্ল্যাট। স্ত্রীর নামে কক্সবাজারের ইনানীর দুটি স্থানে রয়েছে ১ দশমিক ৪৮ একর জমি, যার মূল্য দেখিয়েছেন ৩ কোটি টাকা। ঢাকায় ড. কুদরত ই খুদা রোডে রয়েছে ছয়তলা বাড়ি। গুলশানে আছে ফ্ল্যাট।
শেখ তন্ময় সম্পদ
শেখ হেলালের ছেলে শেখ তন্ময় বাগেরহাট-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য ছিলেন দু’বার। তাঁর বাবার অফিস যে ভবনে, সেই ভবনে ‘শেখ লজিস্টিকস’ নামে তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ব্যবসাসহ অন্যান্য খাত থেকে বছরে তাঁর আয় ৮৬ লাখ টাকা।
তাঁর কাছে ২ কোটি টাকা মূল্যের তিনটি গাড়ি ও ব্যবসায় পুঁজি আছে ৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা। পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠা জমি রয়েছে তাঁর। যার মূল্য দেখিয়েছেন ৩০ লাখ টাকা।
গোপালগঞ্জ ও বাগেরহাটে সম্পদ
শেখ হেলালের ফকিরহাট উপজেলার পিলজং এলাকায় ২ একর জমি, মোল্লাহাট উপজেলার কুলিয়া এলাকায় ৪ দশমিক ০৬ একর জমির খবর পাওয়া গেছে। তবে জেলায় তন্ময়ের কোনো জমি বা বাড়ির খবর পাওয়া যায়নি।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া হেলিপ্যাডে প্রবেশের বাঁ পাশে শেখ জুয়েলের স্ত্রী শম্পা ইয়াসমিন ৪০ শতক জমি কিনেছেন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম তৌফিকুল ইসলাম মধ্যস্থতা করে টুঙ্গিপাড়ার পুবের বিলে শেখ জুয়েলের নামে অন্তত ৫০ বিঘা জমি কিনে দিয়েছেন। এ ছাড়া পাটগাতী, ডুমরিয়া ও গোপালপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন বিলে শেখ জুয়েলের নামে কিছু জমি কেনা হয়েছে বলে স্থানীয়দের দাবি।
হেলাল কিংবা তার ভাইদের কারও কেন্দ্রীয় বা দলের গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদ ছিল না। দলীয় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও প্রভাব ছিল না খুব একটা। কিন্তু দলে কেউ গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে হলে তাদের সায় থাকতে হতো। জাতীয় কিংবা স্থানীয় নির্বাচনে খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা ও ঝিনাইদহ জেলার মনোনয়নপ্রত্যাশীদেরও এই পরিবারের আশীর্বাদ নেওয়া অনেকটাই বাধ্যতামূলক ছিল।
এক্ষেত্রে তারা শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই- এ পরিচয়টাই তাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। এটি ব্যবহার করে তারা সম্ভাব্য কিংবা ‘নির্বাচিত’ সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে যথাসম্ভব সুবিধা আদায় করে নিতেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, সরকারি চাকরিতে নিয়োগ, বদলি ও উন্নয়ন কাজের টেন্ডারের ক্ষেত্রে এই পরিবারের শক্ত প্রভাব ছিল বলে তারা বিশ্বাস করতেন। এটাও ভাবতেন যে, এই পরিবারকে সন্তুষ্ট না করে তাদের পক্ষে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
শেখ হেলাল ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
বাগেরহাট-১ আসনের সাবেক এমপি শেখ হেলাল উদ্দিন ও তার স্ত্রী শেখ রূপা চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুইটি মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলা দুটি দায়ের করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন।তিনি বলেন, সাবেক এমপি শেখ হেলাল উদ্দিনের জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ছয় কোটি ৪৫ লাখ ৫৭ হাজার ৪০৪ টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া, ২০১৫ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তার নিজ নামের সাতটি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ৫৩ কোটি ৫৪ লাখ ৪৩ হাজার ৪৫১ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। যা সম্পত্তির অবৈধ উৎস গোপনের জন্য এসব অর্থ রূপান্তর ও স্থানান্তর করেছেন। এসব অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইনসহ দুদকের সংশ্লিষ্ট আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
অন্যদিকে, শেখ হেলালের স্ত্রী শেখ রূপা চৌধুরীর নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ছয় কোটি ৮২ লাখ ৮৪ হাজার ২৫৮ টাকার সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক। এ অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।