অনুসন্ধানী সংবাদ

নিম্নমানের মশার কয়েলে সয়লাব বাজার, স্বাস্থ্যঝুঁকিতে মানুষ

coil 2 20230910101819
print news

বছরের শুরুতেই বোঝা যাচ্ছিল এ বছর চোখ রাঙাবে ডেঙ্গু। তবে শুধু চোখ রাঙিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, এরই মধ্যে সাড়ে ছয় শতাধিক মানুষের প্রাণ কেড়েছে মশাবাহিত এ রোগ। ডেঙ্গুর এই প্রকোপে মশা থেকে বাঁচতে বেড়েছে কয়েলের চাহিদা। বিক্রেতারা বলছেন, অন্য বছরের তুলনায় এবছর মশার কয়েলের চাহিদা বেড়েছে অন্তত তিনগুণ। এই সুযোগে বাজার ছেয়ে গেছে নিম্নমানের অনুমোদনহীন নন-ব্র্যান্ডের কয়েলে।

বাজার ঘুরে জানা যায়, নিম্নমানের এসব কয়েল ‘পাঁচ-দশের কয়েল’ এবং ‘বাংলা কয়েল’ নামেও পরিচিত। এসব কয়েলে উচ্চমাত্রার রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে দ্রুত মশা তাড়ায়, দামেও সস্তা। ফলে চাহিদার বাজারে এসব নন-ব্র্যান্ডের কয়েলের হিস্যাই এখন বেশি। তবে নিম্নমানের এসব কয়েল জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

রাজধানীর পূর্ব রামপুরা থেকে সিপাহীবাগ এলাকার মধ্যে যে রাস্তা তার দুইপাশে নবীনবাগ ও ছেহেরুনবাগ এলাকা। এসব এলাকার বেশিরভাগ মানুষ নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত। সরেজমিনে ওই এলাকায় অন্তত ৫০টি দোকান ঘুরে দেখা যায়, এসব দোকানে যেসব কয়েল বিক্রি হয় সেগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ নন-ব্র্যান্ডের। এসব কয়েলের নেই কোনো অনুমোদন।

 

লিজার্ড, লেপার্ড, চিতা, র‌্যাপিড, তিতাস, তিতাস প্লাস, জেড ফায়ার, লিড ফায়ার, পাতাবাহার, তুলসী পাতা, নিমপাতা, ওয়্যারস্টার, স্টারপ্লাস নামের কয়েলের দখলে সব দোকান। এগুলো বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) অনুমোদিত ব্র্যান্ড নয়। তবে কোনো কোনোটি অনুমোদিত ব্র্যান্ড হলেও বাজারে ওই নামে নকল কয়েল মিলছে অহরহ। ক্রেতাদের জন্যও বুঝতে পারা কঠিন কোনটা আসল, কোনটা নকল কয়েল? এমনকি এসব কয়েলের প্যাকেটের গায়ে নেই কোনো উৎপাদক বা বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট ঠিকানা। আবার কোনো কোনো কয়েলের প্যাকেটে বিএসটিআইয়ের লোগো সাঁটা থাকলেও সেগুলো বিএসটিআই অনুমোদিত নয়।

অন্য বছরের তুলনায় এ বছর মশার কয়েলের চাহিদা বেড়েছে অন্তত তিনগুণ। এই সুযোগে বাজার ছেয়ে গেছে নিম্নমানের অনুমোদনহীন নন-ব্র্যান্ডের কয়েলে। যেগুলো এখন ‘পাঁচ-দশের কয়েল’ এবং ‘বাংলা কয়েল’ নামেও প্রচলিত।

কথা হয় এসব কয়েলের ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে। অধিকাংশ বিক্রেতা এসব কয়েলের অনুমোদনের বিষয়ে জানেন না। অনেকে আবার ঠিকঠাক কয়েলের ব্র্যান্ডের নামও বলতে পারেন না। বিভিন্ন নামের কয়েল থাকায় কেউ কেউ এগুলোর নাম দিয়েছেন ‘বাংলা কয়েল’। আবার অনেকে নাম ছাড়াই ‘পাঁচের কয়েল’ (পাঁচ টাকা মূল্যের) ও ‘দশের কয়েল’ হিসেবে বিক্রি করেন। এসব কয়েলের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বা কোনো বিক্রয় প্রতিনিধির খোঁজ নেই বিক্রেতার কাছে। শুধু আছে কয়েকটি মোবাইল ফোন নম্বর। কয়েলের চাহিদা থাকলে ওই নম্বরে ফোন দিয়ে নতুন কয়েল নেন তারা।

 

ছেহেরুনবাগের খালেক স্টোরের বিক্রেতা আব্দুল খালেক বলেন, ‘একজন সাইকেলে করে এসে এসব কয়েল দিয়ে যান। কয়েলের নামের কোনো ঠিক নেই। একেক সময় একেক নামের কয়েল সরবরাহ করেন। তবে এসব কয়েলে কাজ হয়, মশা মরে। তাই চাহিদা বেশি।’

আগে কয়েল কেনার ক্ষেত্রে ক্রেতারা জনস্বাস্থ্যের বিষয়ে গুরুত্ব দিতেন। তবে এখন ডেঙ্গু আতঙ্কে শুধু মশা তাড়ানোর বিষয়টিই ভাবছেন। ফলে অনুমোদনহীন নন-ব্র্যান্ডের কয়েলে ঝুঁকছেন তারা। নিম্নমানের এসব কয়েলে অতিমাত্রায় রাসায়নিক ব্যবহার হওয়ায় বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।

তিনি দাবি করেন, ‘ভালো ব্র্যান্ডের কয়েলেই মশা যায় না। এগুলো একটা লাগিয়ে (জ্বালিয়ে) দিলে কোনো মশা থাকবে না, চ্যালেঞ্জ।’

 

কয়েকটি দোকানে অপেক্ষা করে বেশ কিছু ক্রেতার সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। এসব ক্রেতা কোনো কয়েলের ব্র্যান্ডের নাম ধরে নয়, মূল্য দিয়ে চাহিদা দিচ্ছেন বিক্রেতাকে। অর্থাৎ তারাও বিক্রেতাকে বলছেন, পাঁচ/দশ টাকার কয়েল দিতে।

মামুন হোসেন নামের এক ক্রেতা বলেন, ‘ভাই নাম দিয়ে কী হবে? মশা যাওয়া নিয়ে কথা। যে পরিমাণ মশা, তাতে বাংলা কয়েল ছাড়া কাজ হয় না।’

 

খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় অন্য বছরের তুলনায় কয়েলের বেচাকেনা বেড়েছে তিন থেকে পাঁচগুণ। আগে কয়েল কেনার ক্ষেত্রে ক্রেতারা জনস্বাস্থ্যের বিষয়ে গুরুত্ব দিতেন। ফলে ব্র্যান্ডের কয়েল খুঁজতেন তারা। তবে এখন ডেঙ্গু আতঙ্কে শুধু মশা তাড়ানোর বিষয়টিই ভাবছেন। ফলে অনুমোদনহীন নন-ব্র্যান্ডের কয়েলে ঝুঁকছেন ক্রেতারা। নিম্নমানের এসব কয়েলে অতিমাত্রায় রাসায়নিক ব্যবহার হওয়ায় বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। তবে দেশের সুপরিচিত কয়েলের ব্র্যান্ডগুলোর বিক্রিও বেড়েছে। যদিও তা মূল বাজারের আকারের তুলনায় অনেক কম। ফলে দেশের কয়েলের বাজারের বড় অংশই এখন নন-ব্র্যান্ডের দখলে।

কয়েল উৎপাদন করে এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে এখন কয়েলের বাজার প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার। বিশাল এই বাজারের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি দখল নিম্নমানের কয়েলে।

অবৈধ কয়েল উৎপাদন-বিক্রি বন্ধে প্রতি সপ্তাহে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে বিএসটিআই। তবে বিএসটিআই একটি প্রতিষ্ঠান সিলগালা করলে তারা আরেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ব্র্যান্ডের নাম পাল্টে অন্য এলাকায় গিয়ে আবারও একই কাজ করেন।

বাংলাদেশ মসকিউটো কয়েল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমসিএমএ) সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির  বলেন, ‘নকল ও নিম্নমানের কয়েলের বাজার বাড়ছে, এটা ব্যবসায়ীদের জন্যও উদ্বেগের। এতে জনগণের মতো প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ভালো ব্র্যান্ডগুলো বাজার হারাচ্ছে। আবার ব্র্যান্ডের নামের হুবহু নকল কয়েল ওই ব্র্যান্ডের সুনাম ক্ষুণ্ন করছে। কয়েলের বাজার এখন নন-ব্র্যান্ডের হাতে চলে যাওয়ায় এক ধরনের বিশৃঙ্খলাও দেখা দিয়েছে।’

 

তিনি বলেন, ‘উচ্চমাত্রার রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে এসব কয়েল দ্রুত মশা তাড়ায় বা নিধন করে ঠিকই, কিন্তু জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। দেশের কমপ্লায়েন্ট বা মানসম্পন্ন কারখানাগুলো এটা করে না, আমাদের এ সংক্রান্ত নীতিমালা মেনে চলতে হয়। ফলে নন-ব্র্যান্ডের কয়েলের কাছে ব্র্যান্ডের কয়েল বাজার হারাচ্ছে। অন্যদিকে বাড়তি খরচ না থাকায় নন-ব্র্যান্ডগুলো সস্তায় কয়েল বিক্রি করতে পারে, তাদের মুনাফাও বেশি।’

দেশে কয়েলের বাজারে একসময় মরটিন, এসিআই, গুডনাইট, ঈগল, গ্লোবসহ আরও কয়েকটি ব্র্যান্ড বেশ পরিচিত ছিল। এসব ব্র্যান্ডের নকল কয়েলও এখন অহরহ মিলছে বাজারে। ফলে প্রকৃত ব্র্যান্ডগুলোর বাজারে দখল কমছে। তাদের জায়গা দখলে নিচ্ছে নকল ও নিম্নমানের কয়েল। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে চীনের কয়েল। মূলত ২০১৬ সাল থেকে চীন থেকে প্রচুর কয়েল বাংলাদেশের বাজারে আসতে শুরু করে। একপর্যায়ে চীনের অনুমোদনহীন এসব কয়েল বাজারের এক বড় অংশ দখল করে নেয়। এরপর দেশেও ছোট ছোট কারখানা গড়ে ওঠে, যারা চীনের ওইসব কয়েলের অনুকরণ করে লো স্মোক (কম ধোঁয়া) কয়েল বাজারে ছাড়ে। যাদের অধিকাংশের এখনো কোনো অনুমোদন নেই।

 

মশার কয়েল বিএসটিআইয়ের একটি (অনুমোদন নেওয়া) বাধ্যতামূলক পণ্য, যার অনুমোদন দেয় সংস্থাটি। তবে সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো হাজার হাজার কয়েল তৈরির কারখানা রয়েছে। যার মধ্যে বিএসটিআইয়ের মান সার্টিফিকেট আছে মাত্র ১২৫ প্রতিষ্ঠানের।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসটিআইয়ের উপ-পরিচালক (সিএম) রিয়াজুল হক বলেন, ‘অবৈধ কয়েল উৎপাদন-বিক্রি বন্ধে প্রতি সপ্তাহে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে বিএসটিআই। তারপরও আমরা পেরে উঠছি না। একটি প্রতিষ্ঠান সিলগালা করলে তারা আবার আরেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ব্র্যান্ডের নাম পাল্টে অন্য এলাকায় গিয়ে আবারও একই কাজ করেন।’

বিএসটিআই জানিয়েছে, নানা অনিয়মের কারণে এরই মধ্যে লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে তিন প্রতিষ্ঠানের। এছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ২৭টি কয়েল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা করা হয়েছে। জরিমানা করা হয়েছ ৩৫ লাখ টাকা। পাশাপাশি ১০ লাখ টাকার কয়েল ধ্বংস করা হয়েছে।

 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার মশাবাহিত বিভিন্ন রোগ নিয়ে গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন। গবেষণার অংশ হিসেবে তিনি ২০০২ সাল থেকে মশা ও কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ এবং বিতরণ সামগ্রী পরীক্ষা করেছেন নিয়মিত। নিম্নমানের কয়েলের বিষয়ে জাগো নিউজকে ড. কবিরুল বাশার জানান, এ পর্যন্ত তিনি ৬০টির বেশি ব্র্যান্ড ও নন-ব্র্যান্ডের কয়েল পরীক্ষা করেছেন। তাতে তিনি মাত্র ৬-৭টি ব্র্যান্ডের কয়েল পেয়েছেন, যেগুলো যথার্থ কার্যকর, সঠিক মাত্রায় রাসায়নিকের ব্যবহার হয়েছে। নন-ব্র্যান্ডের কয়েলগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক পেয়েছেন তিনি।

ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘মশা তাড়ায় এমন কয়েলের ব্র্যান্ডের সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু সেগুলোতে নির্ধারিত মানের অতিরিক্ত মাত্রায় রাসায়নিক ব্যবহার হয়েছে। যেটা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে।’

 

তিনি বলেন, ‘আরও সমস্যা আছে। যেসব কয়েল কার্যকর সেগুলোর আসল পণ্য বাজারে পাওয়াও মুশকিল। প্রচুর নকল পণ্য রয়েছে। নকলের কারণে ভালো কোম্পানিগুলো উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাজার হারাচ্ছে।’

কয়েলের স্বাস্থ্যঝুঁকি বিষয়ে হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী  বলেন, মশার কয়েলে পারমেথ্রিন, বায়ো-অ্যালোথ্রিন, টেট্রাথ্রিন, ইমিপোথ্রিনের মতো রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। কোনো পণ্যে অতিরিক্ত মাত্রায় এসব ব্যবহার হলে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি ও ফুসফুসের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনকি দীর্ঘমেয়াদে কিডনি রোগ এবং ক্যানসারেরও ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

‘এছাড়া কয়েলের ধোঁয়া থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোঅক্সাইড বের হয়, যা শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। বিশেষ করে গর্ভবতী নারী ও শিশুর বেশি ক্ষতি করে। গর্ভপাতের মতো ঘটনাও ঘটে। শুধু তাই নয়, একটি মশার কয়েল থেকে যে পরিমাণ ধোঁয়া বের হয়, তা একশটিরও বেশি সিগারেটের ক্ষতির সমান।’

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ ডেস্ক :

About Author

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *