/

শোকে পাথর রাজাপুরের সাঙ্গর ও সাউথপুর

print news

ইত্তেহাদ নিউজ,ঝালকাঠি : একসঙ্গে এত লাশ আগে আর কখনো দেখেনি সাউথপুর আর সাঙ্গর গ্রামের মানুষ। বুধবার দুপুরে গাবখান টোলে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৪ জন মারা যাওয়ার খবর পেয়েছিলেন তারাও। তবে বুঝতে পারেননি যে তাদের গ্রামেই আসবে ৭টি লাশ।

রাত ১১টায় হিমায়িত গাড়িতে লাশগুলো যখন আসে গ্রামে তখন অন্ধকার যেন আরও কালো হয়ে চেপে বসে। নিহতের স্বজনরাই শুধু নন, কান্নায় ভেঙে পড়েন দুই গ্রামের প্রায় সবাই। বেশি শোক ছড়ায় হাসিবুর রহমান প্রিন্সের মৃত্যুতে।

সাউথপুরে যার পরিচিতি ছিল দানবীর হিসাবে। বিপদে-আপদে বহু মানুষকে সহায়তা ছাড়াও কম করে হলেও ১০০ জনকে চাকরি দিয়েছিলেন এই প্রিন্স। তার অকাল মৃত্যু কোনোভাবেই মানতে পারছিলেন না কেউ।

সবার কান্না ছাপিয়ে কানে আসছিল নিহত প্রিন্সের শ্বশুর তারেক মৃধার বিলাপ। দুই মেয়ে, জামাই আর নাতি-নাতনি হারিয়ে শোকে পাগলপ্রায় তারেক মৃধা। বিলাপ করে বলছিলেন, আমার নাতিরা কই? আমার মাইয়ারা কই? আমারে আমার মাইয়া আর নাতী-নাতনীগো ফিরাইয়া দাও।

ঝালকাঠী শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের দুই ইউনিয়ন মঠবাড়ি আর শুক্তাগর। দুই ইউনিয়নের পাশাপাশি দুই গ্রাম উত্তর সাউথপুর আর সাঙ্গর। বুধবারের সড়ক দুর্ঘটনায় যে ১৪ জন মারা গেছেন তাদের মধ্যে ৭ জনেরই বাড়ি এই দুই গ্রামে। এদের ৬ জন একই পরিবারের। দানব ট্রাকের পিষে দেওয়া প্রাইভেটকারে ছিলেন তারা। এছাড়া নিহত ইব্রাহিম (৩২) ছিলেন ওই গাড়ির চালক।

দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া হাসিবুর রহমান প্রিন্সের ভাই হাবিবুর রহমান জানান, একটি কুরিয়ার সার্ভিসের সিলেট বিভাগের ব্যবস্থাপক পদে কাজ করতেন প্রিন্স (৩২)। স্ত্রী নাহিদা আক্তার (২৭), দুই সন্তান নূরজাহান তাকিয়া (৪) ও রিফাত তাহমিদকে (১) নিয়ে ছিল সুখের সংসার। মাত্র ২৮ দিন আগে বিয়ে হয় প্রিন্সের শ্যালিকা মাদ্রাসাছাত্রী নিপার (২২)। স্বামী ইমরান (২৬) চাকরি করতেন বিমানবাহিনীতে। কিছুদিন আগে সিলেট থেকে বরিশালে বদলি হন প্রিন্স।

বুধবার বরিশালে যাচ্ছিলেন নতুন বাসা দেখতে। সঙ্গে ছিল স্ত্রী, দুই সন্তান, সদ্য বিবাহিতা শ্যালিকা ও তার স্বামী। বরিশালে বাসা নিলে সেখানে শ্যালিকা নিপাও থাকবে এমনটাই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু সবকিছুই ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল দানব ট্রাকের ধাক্কায়। সবাই লাশ হয়ে ফিরলেন বাড়িতে। সাউথপুর গ্রামের বাসিন্দা একরামুল কবির বলেন, কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। বুধবার সকালেও যে মানুষটার (প্রিন্স) সঙ্গে দেখা হলো, কথা হলো-সে আর নেই। যে কোনো বিপদে পড়ে তার কাছে গেলে মিলত সহায়তা। এই গ্রামের বহু মানুষকে চাকরি দিয়েছেন তিনি।

ক্ষুব্ধ সাঙ্গর-সাউথপুর, জানাজায় হাজারো মানুষ : বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় সাউথপুর গ্রামে প্রিন্স ও তার স্ত্রী-সন্তানসহ ৪ জনের জানাজা হয়েছে। ইমরান-নিপার জানাজা হয় পাশের সাঙ্গর গ্রামে। দুই জানাজাতেই ছিল হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণ। শোকের পাশাপাশি তীব্র ক্ষোভের চিহ্ন ছিল সবার চোখেমুখে।

সাঙ্গর গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ার হাওলাদার বলেন, ‘দুর্ঘটনার যে ভিডিও দেখেছি তাতে মনে হয়েছে এটা দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আমরা চাই সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এ ঘটনার বিচার।’ এদিকে সকালে জানাজা শেষে লাশ দাফন হয় দুর্ঘটনাকবলিত প্রাইভেটকারের চালক ইব্রাহিমের। ইমরান আর নিপার দাফনও হয় জানাজার পরপরই। তবে প্রিন্স, তার স্ত্রী, দুই সন্তানের জানাজা সকালে হলেও দাফন হয় বিকাল সাড়ে ৪টায়। প্রিন্সের দুবাই প্রবাসী সেজো ভাই গ্রামে পৌঁছানোর পর দাফন সম্পন্ন হয় এই ৪ জনের। এছাড়া নিহত বাকি ৭ জনেরও দাফন সম্পন্ন হয়েছে তাদের নিজ নিজ ঠিকানায়।

মেহেদির রং শুকোনোর আগেই লাশ নিপা-ইমরান : ঈদুল ফিতরের মাত্র কয়েক দিন আগে বিয়ে হয়েছিল ইমরান আর নিপার। বিমানবাহিনীতে কর্মরত ইমরানের কর্মস্থল ছিল পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলায়। নিপার বাবা তারেক মৃধা বলেন, মাত্র ২৮ দিন আগে বিয়ে হয়েছিল আমার ছোট মেয়ের। এখনো অনুষ্ঠানিকভাবে তুলে নেওয়া হয়নি তাকে। মেজো জামাই প্রিন্সের বদলির সুবাদে উদ্যোগ নেওয়া হয় বরিশাল শহরে বাসা ভাড়া নেওয়ার। কথা ছিল নিপাও থাকবে সেখানে। বরিশালে বোনের সঙ্গে থেকে পড়াশোনা করবে।

সেই উদ্দেশ্যেই সবাই আনন্দ করতে করতে একসঙ্গে যাচ্ছিল বরিশাল। চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে বৃদ্ধ তারেক মৃধা বলেন, আমার দুই মেয়ে, তাদের জামাই আর নাতি-নাতনী কেউ নেই। আমি কি করে নিজেকে সান্ত্বনা দেব? নিপার বড় বোন তরিকা আক্তার বলেন, এই ঈদে হাতে মেহেদি পরেছিল নিপা। এর আগে মেহেদি পরেছিল বিয়ের সময়। নতুন করে মেহেদি পরার সময়ও ছিল বিয়ের সময়ের মেহেদির ছাপ। সেই বোনটা আজ লাশ হয়ে শুয়ে আছে।

ইব্রাহীমের মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ স্বজন : সবচেয়ে করুণ পরিস্থিতি প্রাইভেটকারের চালক ইব্রাহিমের বাড়িতে। ৫ বছর আর ৬ মাসের দুই ছেলের বাবা ইব্রাহিমের মৃত্যু যেন স্তব্ধ করে দিয়েছে সব। অবুঝ শিশুরা কিছু না বুঝলেও ইব্রাহিমের স্ত্রী সালমার (২৮) আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠছিল চারপাশ। নিহত ইব্রাহিমের মা সেতারা বেগম বলেন, এই দুই অবুঝ শিশু আর বউডারে লইয়া আমি এহন কই যামু? সংসার চলত ইব্রাহিমের আয়ে। হে নাই, এহন আমাগো সংসার চলব ক্যামনে? ছোড ছোড দুইডা বাচ্চা লইয়া বউডাই বা যাইবো কই?

লাইসেন্স ছিল না চালকের, থানায় মামলা : যে ঘাতক ট্রাকের ধাক্কায় অকালে প্রাণ হারান ১৪ জন মানুষ, সেটি চালানোর বৈধ লাইসেন্স ছিল না এর চালক আল আমিনের। দুর্ঘটনার ৩ ঘণ্টার মধ্যে সে এবং তার সহকারী নাজমুল রনিকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। ঝালকাঠী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম বলেন, চালক আল আমিনের ছোট গাড়ি চালানোর লাইসেন্স থাকলেও ট্রাকের মতো ভারী যান চালানোর লাইসেন্স ছিল না।

এছাড়া দুর্ঘটনার সময় ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ সিমেন্ট বহন করছিল। ট্রাকের মালিকের নাম মিনারা বেগম। তার বাড়ি খুলনায়। এদিকে নিহত প্রিন্সের ভাই হাবিবুর রহমান জানান, এ বিষয়ে ঝালকাঠী সদর থানায় একটি মামলা করেছেন তিনি। এতে আসামি করা হয়েছে চালক ও তার সহকারীকে।

বৃহস্পতিবার দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের দেখতে যান সদর আসনের এমপি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু। তিনি হতাহতদের স্বজনদের প্রতি সমবেদনা জানান।

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Banner