রুবেল মিয়া নাহিদ :
কর্মব্যস্ত নাগরিক জীবনের একঘেয়েমি দূর করতে ভ্রমণের কোনো বিকল্প নেই। অবারিত সবুজের মধ্যে একটুখানি প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে মানুষ বের হয় তার চেনা গণ্ডি ছেড়ে। ভ্রমণপিপাসু মানুষ প্রতিনিয়ত খুঁজে ফেরে নতুন নতুন জায়গা। তাই আপনি ও ঘুরে আসতে পারেন এমন একটি জায়গা থেকে।
প্রকৃতির নিবিড় ঘনিষ্ঠতা, জলে নৌকায় ঘুরে আসতে পারেন ব্যাংকক বা কলকাতার মতো বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহত্তম ভাসমান পেয়ারা বাজার থেকে। ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই ভাসমান পেয়ারা বাজারটি গড়ে উঠেছে। ঝালকাঠি ও পিরোজপুর সীমারেখায় অবস্থিত ছোট্ট গ্রামের নাম ভিমরুলি।
আরও পড়ুন: সাজেকের বুকে এক টুকরো লুসাই গ্রাম
এখানেই চর্তুমুখী ছোট-বড় খালের মোহনায় প্রতিদিন বিপণী শুরু হয়। তাই ভিমরুলি গ্রামটির নামই শেষমেষ বাজারটির নামের সঙ্গে স্থায়ীভাবে জুড়ে যায়। স্থানীয় ব্যক্তিদের মুখে অবশ্য এই বাজারকে উদ্দেশ্য করে কথা বলার সময় গোইয়ার হাট নামটা শোনা যায়। সাধারণত পেয়ারার মৌসুম শুরু হয় জুলাই মাসে, চলে টানা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
তাই পাইকারি বাজারের দেখা পেতে হলে সেখানে যেতে হবে জুলাইয়ের শেষ দিকের সময়টাতে। সারি সারি ভাসমান নৌকায় সবুজ-হলুদ পেয়ারার ছড়াছড়ি। এখানে আছে অসংখ্য পেয়ারার বাগান। চাষিরা সরাসরি বাগান থেকে পেয়ারা এনে বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন।
ঝালকাঠি জেলার সদর উপজেলার ডুমুরিয়া, কাপড়কাঠি, কাঁচাবালিয়া, ভীমরুলি, হিমানন্দকাঠি, শতদশকাঠি, রামপুর, মীরাকাঠি, শাওরাকাঠি, জগদীশপুর, আদমকাঠি ও পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর, কুরিয়ানা, বংকুরাসহ আরও কিছু গ্রামে প্রায় ২৪ হাজার একর জমিতে পেয়ারার চাষ হয়।
আরও পড়ুন: ঘুরে আসুন ‘বাংলার কাশ্মীর ও দার্জিলিংয়ে’
নবগ্রাম ইউনিয়নের নবগ্রাম, হিমানন্দকাঠি, দাড়িয়াপুর, সওরাকাঠি ও গাভারামচন্দ্রপুর- এই পাঁচটি গ্রামে সবচেয়ে বেশি পেয়ারা উৎপাদন হয়। সব মিলিয়ে ঝালকাঠি সদর উপজেলায় বছরে ২৪ থেকে ২৫ হাজার টন পেয়ারা উৎপাদিত হয়, যা কেনাবেচায় প্রায় ৪৬-৫০ কোটি টাকার লেনদেন হয়ে থাকে। দেশে উৎপাদিত মোট পেয়ারার প্রায় ৮০ শতাংশই উৎপাদিত হয় এই অঞ্চলে।
২৬টি গ্রামের প্রায় ২০ হাজার পরিবার নিজেদের জীবিকা নির্বাহের জন্য এই পেয়ারা বাগানের ওপর নির্ভরশীল। এখানকার মানুষের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস পেয়ারা। শত বছর ধরে গ্রামগুলোতে বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারা চাষ করা হচ্ছে। প্রতিদিন হাটগুলোতে ১০ থেকে ১৫ হাজার মণ পেয়ারা বেচা-কেনা হয়।
ছোট খাল জুড়ে সপ্তাহের প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাজার চলে। পেয়ারা বোঝাই শত শত নৌকা দেখলে বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। চাষিরা ফল দিয়ে নৌকা বোঝাই করে ও ক্রেতাদের সন্ধান করে। হাটগুলোতে ব্যবসায়ীরা পেয়ারা কিনে ট্রলারযোগে ও ট্রাকে করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, ফরিদপুর, নোয়াখালী, ভোলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যায়।
দ্রুত পচনশীল পেয়ারা ও সবজি সংরক্ষণে জেলায় কোনো হিমাগারের ব্যবস্থা না থাকলেও পদ্মা সেতুর কল্যাণে এখন তিন থেকে চার ঘণ্টার মধ্যে পাইকারেরা পেয়ারা নিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে পারেন। ভাসমান বাজারের উত্তর প্রান্তে খালের ওপর একটি ছোট সেতু আছে, যেটি এখানকার মূল আকর্ষণ। কেননা সেতু থেকে বাজারের পুরোটা খুব ভালোভাবে দেখা যায়।
মজার ব্যাপার হলো এই বাজারে পেয়ারা বহনকারী সব নৌকার নকশা ও আকার প্রায় একই। মনে হয় একই কারিগর সব নৌকা বানিয়েছে। পেয়ারা বাগানে প্রবেশের জন্য ছোট ছোট পরিখা করা হয়েছে। ছোট নৌকা নিয়ে সেখানে ঢুকে চাষিরা পেয়ারা পাড়েন। খাল সংলগ্ন প্রতিটি বাড়িতে একটি করে ডিঙ্গি নৌকা থাকে।
স্থানীয়রা এগুলোকে কষা নৌকা বলে। এগুলো দিয়েই বাজার-হাট, যাতায়াত যাবতীয় কাজ করা হয়। ছোট নৌকাগুলো সরাসরি পরিখা দিয়ে বাগানে ঢুকে পড়তে পারে। বড়গুলোকে পাড়ে রেখে চাষিরা বাগানে নেমে পড়ে। খাল সংলগ্ন বাড়িঘর, স্কুল, ব্রিজ, রাস্তাঘাটের দৃশ্য যে কাউকে বাংলার বুকে এক টুকরো থাইল্যান্ড বা ইতালির ভেনিসের অনুভূতি দেবে।
আর মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে কোনো ভ্রমণপিপাসু মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ার অবকাশ পাবেন না।তাছাড়া এখানে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তোলা হয়েছে বিনোদনকেন্দ্র ও পিকনিক স্পট। পর্যটকেরা এসব বিনোদনকেন্দ্রে যাত্রাবিরতি করেন। পেয়ারাবাগান ও ভাসমান হাট ঘিরে দিন দিন বাড়ছে পর্যটকের আনাগোনা। এসব বিনোদনকেন্দ্রে ঢুকতে লাগে ২০- ৪০ টাকা। এগুলোর ভেতরে রয়েছে বিশ্রামের ব্যবস্থা ও পিকনিক করার সুবিধা।
ব্যবসায়ী নাসির হোসেন বলেন, ‘পেয়ারার বাজার কেবল বসতে শুরু করেছে। আরও কয়েকদিন গেলে বেশ জমজমাট হবে। এখন পেয়ারার পাশাপাশি প্রচুর লেবুও পাওয়া যাচ্ছে বাজারগুলোতে। নৌকায় করে চাষিরা ক্ষেত থেকে নিয়ে আসছেন, আর পাইকাররা দরদাম করে কিনে নিচ্ছেন। এখানকার বেশিরভাগ ফসল প্রাকৃতিক সার ও আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনায় করা হয় বিধায় মান খুব ভালো, আর দামও খুব একটা বেশি হয় না। উৎপাদন বেশি হলে পেয়ারার দাম কম থাকে।’
কীভাবে যাবেন?
ভাসমান পেয়ারা বাজারে চাইলে অনেকভাবে যেতে পারবেন। নৌ, স্থল এমনকি আকাশপথেও যেতে পারেন। সবচেয়ে ভালো হয় নদীপথ, অর্থাৎ লঞ্চে যাওয়া। ঢাকা-বরিশাল-স্বরূপকাঠি-ঢাকা। সদরঘাট থেকে প্রতিদিন রাত ৮টায় বরিশালের উদ্দেশে ছেড়ে যায় অনেকগুলো বিলাসবহুল লঞ্চ। কোনো একটা পূর্ণিমার রাতে উঠে পড়লে বোনাস হিসেবে পাবেন মনোরম জ্যোৎস্না বিলাস।
এর জন্য আপনাকে ভাড়া গুনতে হবে ভিআইপি কেবিনের জন্য ৫০০০-৭০০০ টাকা, সেমি ভিআইপি কেবিন ৪০০০-৪৫০০ টাকা, ফ্যামিলি কেবিন ২৫০০-৩৫০০ টাকা, ডাবল কেবিন ১৭০০-১৮০০ টাকা, সিঙ্গেল কেবিন ৯০০-১০০০ টাকা ও ডেকে জনপ্রতি ২৫৫ টাকা।
আপনাকে সকাল ৭টায় বরিশাল নামিয়ে দেবে। সেখান থেকে নাশতা করে লেগুনা ঠিক করে ফেলুন স্বরূপকাঠি যাওয়ার জন্য। এক লেগুনায় ১৪ জন যাওয়া যায়। রিজার্ভ ভাড়া পড়বে ৪০০-৫০০ টাকা। ছোট গ্রুপ সিএনজি টাইপ টেম্পো ভাড়া করে নিন ২৫০-৩০০ টাকা দিয়ে।
এরপর ১টা ৩০ মিনিট জার্নির পর পৌঁছে যাবেন স্বরূপকাঠি। সেখান থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া করে নিন সারাদিনের জন্য। ভাড়া পড়বে ২০০০-৩০০০ টাকা। আকারভেদে প্রতিটি নৌকায় ১৫-২০ জন মানুষ ধরে। কিছু ছোট নৌকাও পাওয়া যায় তবে খুব কম।
স্থলপথে যেতে চাইলে ঢাকার গাবতলী থেকে সাকুরা পরিবহনের এসি বাসও যায় বরিশাল। ভাড়া ৮০০ টাকা। এ ছাড়া ‘হানিফ’, ‘ঈগল’, ‘সুরভী’ ও ‘সাকুরা’ পরিবহনের নন-এসি বাসও যায়, ভাড়া ৩৫০-৪৫০ টাকা। এছাড়া ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে বরিশাল যাওয়ার জন্য রয়েছে ‘সুগন্ধা’ পরিবহনের বাস।
কোথায় খাবেন?
কুড়িয়ানা বাজারে খাবার দোকান আছে এদের রান্না খুবই ভালো। পাঁচ থেকে সাতজন গেলে আগে বলার দরকার নেই। বড় গ্রুপ গেলে অর্ডার দিয়ে যাবেন।
কোথায় থাকবেন?
যদিও এই ট্যুরে থাকার প্রয়োজন হয় না। সারাদিন ঘুরে আপনি রাতে লঞ্চ ধরে ফিরে আসতে পারেন। তারপর থাকতে চাইলে জেলা শহরের সাধারণ মানের হোটেলই একমাত্র ভরসা। ভালো কোনো হোটেলে থাকতে চাইলে যেতে হবে বরিশাল সদরে।
২ comments
Pingback: পান খেতে মহেশখালী – ইত্তেহাদ
Pingback: মেঘনার টাটকা ইলিশ ও সবজি খিচুড়ি – ইত্তেহাদ