নতুন নতুন জায়গা, সংস্কৃতি ও মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দুর্দান্ত উপায় ভ্রমণ। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার ভাষায়– ‘ভ্রমণ প্রথমে তোমাকে নির্বাক করে দেবে, তারপর তোমাকে গল্প বলতে বাধ্য করবে।’
ব্যস্ত জীবনের ভিড়ে তাই সুযোগ পেলেই ছুটে বেড়াই নতুন কোনো জায়গা দেখার উদ্দেশ্যে। এবারের গন্তব্য প্রাচ্যের ভেনিসখ্যাত বরিশাল। বরিশাল, পিরোজপুর ও ঝালকাঠির বেশ কিছু ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখার জন্য নির্ধারিত দিন রওনা হলাম বাসে। ভাসমান পেয়ারাবাজার আর পেয়ারাবাগান ঘুরে দেখাই এবারের ভ্রমণের মূল লক্ষ্য। পাশাপাশি মিয়াবাড়ি মসজিদ, গুঠিয়া মসজিদ, দুর্গাসাগর দীঘি, সন্ধ্যা নদী, স্বরূপকাঠির নৌকার হাট, ছারছীনা মাদ্রাসা কমপ্লেক্স ও দরবার শরিফ দেখার ইচ্ছা। সব মিলিয়ে জমজমাট একটি ট্রিপের প্রত্যাশা নিয়ে যাত্রা শুরু হলো। ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক ধরে বাস ছুটছিল গন্তব্যের পথে। ভ্রমণসঙ্গী রাশেদ আমিনুল ও ইব্রাহিম মিঠু ভাই। নেছারাবাদের স্বরূপকাঠি বাসস্ট্যান্ডে সকালের নাশতা সেরে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে বেরিয়ে পড়লাম। যেতে যেতে চোখে পড়ল নৌকাভর্তি পেয়ারা, সবুজ গ্রামীণ প্রকৃতি, খালের সঙ্গে লাগোয়া ঘরবাড়ি, স্কুল, ব্রিজ, সাঁকো আর গ্রামীণ জীবনযাত্রার নানা ছবি। আঁকাবাঁকা খাল পেরিয়ে ১ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছলাম ভিমরুলি ভাসমান পেয়ারাবাজারে। যেদিকে চোখ পড়ছিল, সেদিকেই নৌকাভর্তি সারি সারি সবুজ-হলুদ পেয়ারা। সঙ্গে পর্যটকদের নৌকা তো আছেই। এ যেন পেয়ারা চাষি আর পর্যটকদের ভাসমান মিলনমেলা! ফেরার পথে একটি পেয়ারাবাগানে নেমে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। সন্ধ্যা নদীতে গোসলের পর স্বরূপকাঠিতে মধ্যাহ্নভোজ সেরে টং দোকানে চা খেয়ে খানিক বিরতি। এর পর একে একে ঘুরে দেখলাম মিয়াবাড়ি মসজিদ, নৌকার হাট ও দুর্গাসাগর দীঘি। ভাসমান পেয়ারাবাজার থাইল্যান্ড, ভারতের কেরালা, ইতালির ভেনিস ও ফিলিপাইনের ভাসমান বাজারের মতো বাংলাদেশেও আছে ভাসমান বাজার। বরিশালের বানারীপাড়া, পিরোজপুরের নেছারাবাদ ও ঝালকাঠি সদর উপজেলার ছোট-বড় খালজুড়ে বসে দেশের সবচেয়ে বড় ভাসমান পেয়ারা ও সবজির বাজার। পেয়ারা, আমড়া, সুপারি, আখ, নারকেল, কাঁঠাল, কলা ও কৃষকের উৎপাদিত অন্যান্য কৃষিপণ্য বিক্রি হয় এসব বাজারে। সাধারণত পেয়ারার মৌসুম শুরু হয় জুলাই মাসে, চলে টানা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। আঁকাবাঁকা নদী, পেয়ারাভর্তি নৌকা, খালের দু’ধারের সবুজাভ পরিবেশ– সবকিছু মিলে সে এক অন্যরকম সৌন্দর্য। বানারীপাড়া, নেছারাবাদ ও ঝালকাঠি সদর– এই তিন উপজেলার ৫৫ গ্রামে ছড়িয়ে আছে পেয়ারাবাগান ও হাটবাজার। মিয়াবাড়ি মসজিদ বরিশাল সদরের কড়াপুর ইউনিয়নের রায়পাশা গ্রামের প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন মিয়াবাড়ি মসজিদ। এটির নির্মাণকাল ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ বলে মনে করা হয়। জনশ্রুতি রয়েছে, মিয়াবাড়ি মসজিদটি বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের ব্রিটিশ আমলের সূচনালগ্নে নির্মিত। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা হায়াত মাহমুদ এ মসজিদ নির্মাণ করেন। গুঠিয়া মসজিদ বায়তুল আমান জামে মসজিদ ও ঈদগাহ কমপ্লেক্স, যা সবার কাছে গুঠিয়া মসজিদ নামেই বেশি পরিচিত। বরিশালের উজিরপুরের গুঠিয়া ইউনিয়নে এই মসজিদ অবস্থিত। অপূর্ব কারুকার্যে তৈরি গুঠিয়া মসজিদের নির্মাণ শুরু হয় ২০০৩ সালে। মসজিদ ভবনের সৌন্দর্য বাড়াতে বিভিন্ন স্থানে বর্ণিল কাচ, মূল্যবান মার্বেল পাথর, গ্রানাইট ও সিরামিক দিয়ে করা হয়েছে নকশার কাজ। মসজিদে দৃষ্টিনন্দন ঝাড়বাতি ছাড়াও রয়েছে বাহারি নকশার আলোকবাতির ব্যবস্থা। এ ছাড়া বাইরে মসজিদ ও ঈদগাহ কমপ্লেক্স ঘিরেও রয়েছে বাহারি আলোকবাতি, যা রাতের বেলা মসজিদের সৌন্দর্য কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। মসজিদটির তিন পাশে খনন করা হয়েছে কৃত্রিম লেক। মসজিদ চত্বরে রয়েছে মাদ্রাসা ও নারীদের জন্য আলাদা নামাজের জায়গা। ঐতিহ্যবাহী নৌকার হাট শত বছরের পুরোনো পিরোজপুরের নৌকার হাট। জেলার নেছারাবাদ উপজেলার আটঘর-কুড়িয়ানা ইউনিয়নের আটঘর খালে প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসে এই হাট। হাটকে কেন্দ্র করে আটঘর-কুড়িয়ানা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের সহস্রাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়। জ্যৈষ্ঠ থেকে শুরু করে আশ্বিন পর্যন্ত নৌকা কেনাবেচার ধুম পড়ে এ হাটে। প্রতি সপ্তাহে সোম ও বৃহস্পতিবার বসে এ হাট। দুর্গাসাগর দীঘি ২৩২ বছরের ঐতিহ্যবাহী দুর্গাসাগর দীঘি বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা ইউনিয়নের বানারীপাড়া-বরিশাল সড়কের পাশে অবস্থিত। ইতিহাস, ঐতিহ্য আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা দীঘিটি ৪৫ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। দীঘির তিন দিকে তিনটি ঘাট এবং মাঝখানে একটি টিলা রয়েছে। ১৭৮০ সালে তৎকালীন রাজা শিবনারায়ণ এলাকাবাসীর পানির সংকট নিরসনে বৃহৎ এ দীঘিটি খনন করেন। রাজা শিবনারায়ণের স্ত্রী দুর্গারানীর নামানুসারে এ দীঘির নামকরণ করা হয়।
Check Also
কুয়াকাটায় সুর্যোদয় ও সুর্যাস্ত দেখতে পর্যটকদের ভীড়ে মুখরিত সাগরকন্যা
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের ঢল নেমেছে। সৈকতে হাজার হাজার পর্যটকদের আগমন ঘটেছে। বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার …