কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর : ৭ হাজার কোটি টাকার কৃষি প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ


ঢাকা প্রতিনিধি : বাংলাদেশের কৃষি খাতের সবচেয়ে বড় কর্মসূচি হলো ‘পার্টনার’ প্রকল্প (প্রোগ্রাম অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ট্রান্সফরমেশন ফর নিউট্রিশন এন্টারপ্রেনারশিপ অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স ইন বাংলাদেশ)। ৬ হাজার ৯১০ কোটি টাকার এ প্রোগ্রামে অর্থায়ন করবে বাংলাদেশ সরকার এবং বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল। এই কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে খাদ্য উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি কৃষিতে বৈচিত্র্য আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এমন একটি বিশাল কর্মসূচিতে শুরুতেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্টদের দাবি, পার্টনার প্রকল্পে কনসালট্যান্সি ফার্ম নির্বাচনে অনিয়ম করা হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বাস্তবায়নাধীন এই কর্মসূচির কাজ শুরু হয় গত বছর।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, কর্মসূচি সমন্বয়কারী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ও উপপ্রকল্প পরিচালক ড. গোবিন্দ ইচ্ছাকৃতভাবে সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটির কনসালট্যান্সি ফার্ম নির্বাচনে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্প সমন্বয়কারী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘কোনো প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। শর্টলিস্ট করে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আবেদন করেছিল ১৪-১৫টি প্রতিষ্ঠান। সেখান থেকে ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে শর্টলিস্ট করা হয়েছে। এখান থেকে একটি প্রতিষ্ঠান কাজ পাবে। এগুলো সব প্রতিষ্ঠিত ফার্ম। এমন চিন্তা করার সুযোগ নেই যে ভালো প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে শর্টলিস্ট করেছি।। কেন করব? আমি তো কাউকে চিনি না। আমাদের সব সময় চেষ্টা থাকে বেস্ট প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার। আবার বলছি, এখনো কোনো ফার্মকে নিয়োগই দিইনি। একটিকে নিয়োগ দেওয়া হবে। পাঁচটি বাদ পড়বে।’
এক প্রশ্নের উত্তরে মিজানুর রহমান বলেন, ‘সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী আমাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তদবির বা কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে এখানে আসিনি। ঢাকার বাইরে ছিলাম। সরকার ভালো মনে করেছে, নিয়ে এসেছে। কার অভিজ্ঞতা ছিল, কার ছিল না সেটা মুখ্য না। জাতিসংঘে একটি বড় প্রকল্পে কাজ করেছি। অন্য একটি বড় প্রকল্পেও পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছি। আমার নিয়োগে ব্যক্তিগতভাবে কারও স্বার্থহানি হলে কিছু করার নেই। বহু অভিজ্ঞ লোকও বহু অপরাধ করছে। কম অভিজ্ঞরা অনেক ক্ষেত্রেই ভালো চালাচ্ছে এবং তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতাও নেই।’
মিজানুর রহমান গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর ছয়টি ফার্মকে সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত করে চিঠি দিয়েছেন। ফার্মগুলো হলো ক্রান্তি অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড, সানেম, মাইডাস, আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং, সমাহার কনসালট্যান্টস লিমিটেড এবং সভেভ কনসাল্ট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড।
কর্মসূচি সমন্বয়কারী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ও উপপ্রকল্প পরিচালক ড. গোবিন্দ তাদের পছন্দনীয় অযোগ্য ফার্মকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য কৃষি সচিবের নাম ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি কিংবা আওয়ামীবিরোধী শক্তিকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। ফলে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে এবং দুর্নীতির বেড়াজালে পড়ে প্রকল্পটি নষ্ট হয়ে যাবে।
অভিযোগ উঠেছে, সানেম নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে “ইনডিপেনডেন্ট ভেরিফিকেশন এজেন্সি (আইভা) ফর ‘দ্য ভেরিফিকেশন অব অ্যাচিভমেন্ট অব ডিএলআইএস/ডিএলআরএস’ ফর পার্টনার” প্যাকেজটির কাজ পাইয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে কর্মসূচি সমন্বয়কারী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান কারিগরি মূল্যায়নে সর্বোচ্চ নম্বর দিয়েছেন। এই প্যাকেজের টার্মস অব রেফারেন্সে (টিওআর) প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতার যে শর্ত রয়েছে তার কোনো শর্তই সানেম নামের ওই প্রতিষ্ঠানটি পূরণ করেনি এবং যাকে টিম লিডার দেখানো হয়েছে তার এ ধরনের কাজের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কাজ পাওয়ার শর্ত হিসেবে বলা হয়েছে, টিম লিডারকে এ ধরনের পাঁচটি বড় কাজের এবং ১২ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু সানেমের টিম লিডারের ক্ষেত্রে এগুলোর কোনোটিই নেই। অথচ এ খাতে টিম লিডারকে মিথ্যা মূল্যায়িত করে সর্বোচ্চ নম্বর দেওয়া হয়েছে। অবৈধভাবে কাজ দেওয়ার জন্য সানেমকেও বেশি নম্বর দিয়ে মূল্যায়িত করা হয়েছে।
কর্মসূচি সমন্বয়কারী নিয়োগেও ‘অনিয়ম’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কর্মসূচি সমন্বয়কারী মিজানুর রহমানের নিয়োগই হয়েছে অনিয়মের মাধ্যমে। নিয়োগের নিয়মকানুন ভেঙে গত বছরের ২৫ মে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কুমিল্লা জেলার উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমানকে এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কাজে তার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় যথাযথভাবে প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন নিয়েই অনেকের মধ্যে সংশয় রয়েছে।
নিয়োগের সময় বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে মিজানুর রহমান স্বীকার করে নিয়ে তখন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি এর আগে কোনো প্রকল্পে কাজ করিনি এটা ঠিক; তবে আমার টিমে যারা আছে তাদের অনেকেরই বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারাই আমার ভরসার জায়গা। আমি বলব, তদবির করে এ পদে আসিনি। সরকার ভালো মনে করেছে তাই এই দায়িত্ব দিয়েছে।’
পার্টনার প্রকল্পের উদ্দেশ্য
প্রকল্পটির অন্যতম উদ্দেশ্য তিন লাখ হেক্টর জমিতে উত্তম কৃষিচর্চা (গ্যাপ) প্রটোকল বাস্তবায়নের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন ও বিদেশে রপ্তানি করা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সাতটি সংস্থা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এ প্রোগ্রাম বাস্তবায়িত হবে।
‘পার্টনার’-এর মাধ্যমে ৫টি গুরুত্বপূর্ণ ফল ও ১০টি গুরুত্বপূর্ণ সবজির প্রটোকল প্রস্তুত করা হবে। ফল ও সবজি উৎপাদন এবং রপ্তানি এ প্রোগ্রামের আওতায় থাকবে। এর আওতায় ১০ লাখ কৃষককে উত্তম কৃষিচর্চাবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, বীজ নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করা হবে, বিরূপ পরিবেশ সহনশীল ও উচ্চফলনশীল ৫টি ধানের জাত উদ্ভাবন করা হবে, অন্যান্য ফসলের ১৫টি জাত উদ্ভাবন করা হবে এবং উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে এক লাখ হেক্টর নতুন কৃষিজমি সেচের আওতায় আনা হবে।
‘পার্টনার’-এর মাধ্যমে দেশের ৬৪ জেলার ৪৯৫টি উপজেলায় ২ কোটি ২৭ লাখ কৃষককে সব ধরনের তথ্যসংবলিত স্মার্ট কার্ড দেওয়া হবে, ১০টি অ্যাক্রেডিটেড ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হবে, ধান ও অন্যান্য ফসলের আবাদ সম্প্রসারণে যথাযথ প্রযুক্তিগত ও দক্ষতাবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এবং খাদ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে আধুনিক ল্যাবরেটরি স্থাপনের মাধ্যমে খাদ্যের মান নিশ্চিত করা হবে। খবর খবরের কাগজ
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়