বিমান দুর্ঘটনা: হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে দগ্ধরা


শ্রেয়া ঘোষ। তৃৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছোট্ট শিশুটির দুষ্টমিতে মেতে থাকতো ঘর। এখন নীরব হয়ে গিয়েছে এই প্রাণচঞ্চল শিশুটি। বিমান দুর্ঘটনায় পুড়েছে তার শরীর। যন্ত্রণায় ছটফট করছে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের বেডে। শ্রেয়ার শরীরের ডান দিকটা সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়েছে। বার্ন হয়েছে ৩০ শতাংশ। যন্ত্রণায় কাতর শ্রেয়ার প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন আর্তনাদে ভেঙে পড়ে। টলমল চোখে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারে না। মেয়ের এই হৃদয়ভাঙা যন্ত্রণা দেখে নির্বাক হয়ে পড়েছেন মা। তিনি কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে মানবজমিনকে বলেন, ক্লাস শেষে কোচিংয়ের জন্য গিয়েছিল মেয়েটা। আমি কী জানতাম ওইটাই হবে ওর জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক দিন? আমার সোনামণির দেহটা এখন চিনতে পারি না। শুধু চোখ দুটো চেয়ে থাকে আমার দিকে, অনেক কিছু বলার থাকে, কিন্তু ও কিছুই বলতে পারে না।
শুধু শ্রেয়া নয়, হাসপাতালের বিছানায় দগ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছে আরও অনেক শিশু। শরীরের ব্যান্ডেজ নিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। অনেক মা-বা তাদের শিশুদের নিয়ে চিন্তিত। কেউ কেউ আইসিইউয়ের সামনে নির্বাক দাঁড়িয়ে আছেন। কখন সুস্থ হয়ে তাদের মা-বাবা বলে ডেকে জড়িয়ে ধরবে। শ্রেয়ার মা শুধু তার নিজের সন্তান নিয়েই চিন্তিত নন। তার চোখে বারবার ভেসে উঠছে হাসপাতালে ভর্তি থাকা আশপাশের অন্য শিশুদের পুড়ে যাওয়া মুখ। দগ্ধ হয়ে বেডে শুয়ে থাকা শিশুদের কান্না। হাসপাতাল জুড়েই ছিল স্বজনদের ছোটাছুটি। প্রিয় মুখটিকে দেখতে অনেকে ছুটে এসেছেন দূরদূরান্ত থেকে।
জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙে পড়েছেন শিক্ষার্থী রায়হানের বাবা মনির হোসেন। ছেলেকে খুঁজে না পেয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরছিলেন তিনি। মধ্য রাতে সন্তানের খবর জানতে পেরে ছুটে আসেন ছেলের কাছে হাসপাতালে। জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি আছে তার ছেলে রায়হান। তিনি বলেন, রায়হান নবম শ্রেণিতে পড়ে। ঘরভর্তি হাসি আর দস্যিপনার সেই ছেলে আজ হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। আগুনে পুড়েছে রায়হানের শরীরের ২০ শতাংশ। পিঠের দিকটা পুড়ে গেছে মারাত্মকভাবে। ছেলেটা চোখের সামনে ছটফট করছে, কিন্তু কিছুই করতে পারছি না। গত রাত থেকে কারও চোখে ঘুম নেই। ছেলেকে দেখতে ছুটে এসেছেন আত্মীয়স্বজন। সবার আদরের রায়হান, যে সারাক্ষণ ঘর মাতিয়ে রাখতো, সে আজ নিথর হয়ে শুয়ে আছে হাসপাতালের শীতল শয্যায়। তার ক্লাসের পাশেই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়।
মাহতাব রহমান ভূঁইয়া। ইংরেজি ভার্সনের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার শরীরের প্রায় ৭০ শতাংশ পুড়ে গেছে। হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি রয়েছে। মাহতাবের বাবা মিনহাজুর বলেন, মাহতাব আমার একমাত্র ছেলে। তাকে প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যেতাম আবার স্কুল শেষে নিয়ে আসতাম। এমন ঘটনা ঘটবে কখনো ভাবতে পারিনি। চিকিৎসকরা বলেছেন মাহতাবের শরীরের ৭০ শতাংশ বার্ন হয়েছে। আমার ছেলে আমার বুকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসুক। আমি পরিবার নিয়ে উত্তরায় বসবাস করি। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বারে।
এদিকে হাসপাতালে অতিরিক্ত ভিড় সামলাতে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ভর্তি রোগীদের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশসহ একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সরজমিন দেখা যায়, শুধুমাত্র রোগী, তাদের স্বজন এবং হাসপাতালের কর্মীদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে। প্রবেশপথে অবস্থান করছিলেন সেনা সদস্যরা। আহত রোগীর স্বজনদের ভিড় এবং স্বজনদের উপস্থিতি সামলাতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বার্ন ইনস্টিটিউটে সংবাদ সম্মেলনে জানান, বিভিন্ন হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ২৯ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৬৯ জন। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান জানান, জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে এখন পর্যন্ত ৪৩ জন ভর্তি আছে। এদের মধ্যে ২ জনের অবস্থা উন্নতি হওয়ায় বেডে স্থানান্তর করা হয়েছে। ১০ জনের অবস্থা গুরুতর। যে ২৯ জন মারা গেছেন তাদের মধ্যে ২ জন শিক্ষক। পরিচয় শনাক্ত না হওয়া ৬ জনের মধ্যে ৪ জনের বিপরীতে দাবিদার এসেছে। তাদের ডিএনএ টেস্ট করে ম্যাচ হওয়ার পর লাশ হস্তান্তর করা হবে। তবে এখনো ২টি লাশের দাবিদার আসেনি। তিনি বলেন, আজ রাতেই সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসকদের এক দল বাংলাদেশে আসছে। তারা আসলে চিকিৎসায় কোনো পরিবর্তন প্রয়োজন মনে করলে তারা করতে পারেন।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।